বিবাহ মহান আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ নেয়ামত

হে মানব, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিতি হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক পরহেযগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন। [সূরা আল-হুজুরাতঃ ১৩]

ঈমানদার পুরুষ ও নারীদের সম্পর্কে আল্লাহ্‌ তা'আলা পবিত্র কুরআনে বলেনঃ-

আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক। তারা ভাল কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে। এদেরই উপর আল্লাহ তা'আলা দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশীল, সুকৌশলী। [সূরা আত-তউবাঃ ৭১]

রাসুল (সাঃ) দ্রুত বিবাহের জন্য উৎসাহ দিয়ে বললেন:

হে যুবকেরা! তোমাদের মধ্যকার যে বিবাহের সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে নেয়। (বুখারী-৫০৬৫)

জীবনসঙ্গী পছন্দ করার বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

“চারটি বিষয়কে সামনে রেখে মেয়েদেরকে বিয়ে করা হয় — তার ধন সম্পদ, তার বংশমর্যাদা, তার রূপ-সৌন্দর্য ও তার ধর্মপরায়নতা। এক্ষেত্রে ধর্মপরায়ন স্ত্রী লাভে বিজয়ী হও, তোমার হাত কল্যাণে ভরে যাবে।” [বুখারী ও মুসলিম]

মহানবী (স:)একদিন যুবকদের লক্ষ্য করে বলেন:

যুবকদের লক্ষ্য করে বললেন, হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যে বিয়ের সামর্থ্য রাখে সে যেন বিয়ে করে। কেননা বিয়ে দৃষ্টিকে সংযত করে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। আর যে বিয়ের যোগ্যতা রাখে না, তার উচিত রোজা পালন করা। (বোখারি ও মুসলিম)

Friday, November 28, 2014

তালাক সম্পর্কিত কিছু ভুলত্রুটি

একটি কথা তো বারবার লেখা হয়েছে, ওলামা-মাশায়েখও আলোচনা করে থাকেন যে, অতীব প্রয়োজন (যা শরীয়তে ওজর বলে গণ্য) ছাড়া স্বামীর জন্য যেমন তালাক দেওয়া জায়েয নয় তেমনি স্ত্রীর জন্যও তালাক চাওয়া দুরস্ত নয়। তালাকের পথ খোলা রাখা হয়েছে শুধু অতীব প্রয়োজনের ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য। বর্তমান সমাজে, বিশেষ করে আমাদের এতদাঞ্চলে কোনো পরিবারে তালাকের ঘটনা যে কত ফাসাদ-বিশৃঙ্খলা, জুলুম-অত্যাচার এবং ঝগড়া-বিবাদের কারণ হয় তা আর বলে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। তালাক প্রদানের ক্ষমতাকে শরীয়তের নির্ধারিত নীতিমালার বাইরে ব্যবহার করা নিঃসন্দেহে আল্লাহর বিধানের সাথে বালখিল্যতার শামিল।
এজন্য কেউ দাম্পত্য জীবনে পা রাখার চেষ্টা করলে তার অপরিহার্য কর্তব্য হবে, বিয়ের আগেই দাম্পত্য জীবনের নিত্য প্রয়োজনীয় মাসআলাগুলোর সাথে  তালাকের বিধানসমূহ জেনে নেওয়া।
তালাক অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। কেউ এই ক্ষমতার অপব্যবহার করলে কিংবা ভুল পন্থায় তা প্রয়োগ করলে সে একদিকে যেমন গুনাহগার হবে অন্যদিকে তালাকও কার্যকর হয়ে যাবে। তাই প্রতিটি বিবেচক স্বামীর দায়িত্ব হল, তালাকের শব্দ কিংবা এর সমার্থক কোনো শব্দ মুখে উচ্চারণ করা থেকে সতর্কতার সাথে বিরত থাকা।
অবশ্য অতীব প্রয়োজনে তালাক প্রদানে বাধ্য হলে স্ত্রীর পবিত্র অবস্থায় শুধু এক তালাক দিয়ে ক্ষান্ত হওয়া উচিত। এভাবে বলবে যে, তোমাকে তালাক দিলাম। তালাকের সাথে বায়েন শব্দ কিংবা ৩ সংখ্যা ব্যবহার করবে না। কেউ বায়েন শব্দ বলে ফেললে (চাই তা এক বা দুই তালাক হোক না কেন) নতুন করে শরীয়তসম্মত পন্থায় বিবাহ দোহরানো ছাড়া স্ত্রীর সাথে পুনরায় মিলনের পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
অনুরূপভাবে তিন তালাক দিয়ে ফেললে-একই মজলিসে পৃথক পৃথকভাবে তিন তালাক দেওয়া হোক কিংবা একই শব্দে তিন তালাক দেওয়া হোক- যেমন বলল, তোমাকে তিন তালাক দিলাম। অথবা আগে কখনো দুই তালাক দিয়েছিল আর এখন শুধু এক তালাক দিল। সর্বমোট তিন তালাক দেওয়া হল। যেকোনো উপায়ে তিন তালাক দেওয়া হলে বৈবাহিক সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়ে যায়। এ অবস্থায় শুধু মৌখিকভাবে স্ত্রীকে বিবাহে ফিরিয়ে আনার যেমন কোনো সুযোগ থাকে না তেমনি নতুন করে বিবাহ দোহরানোর মাধ্যমেও ফিরিয়ে নেওয়ার পথ খোলা থাকে না।
একসাথে তিন তালাক দেওয়া কিংবা বিভিন্ন সময় তালাক দিতে দিতে তিন পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া একটি জঘণ্য অপরাধ ও ঘৃণিত কাজ। আল্লাহ তাআলা এর শাস্তি হিসেবে এই বিধান দিয়েছেন যে, তারা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পুনরায় একসাথে বসবাস করতে চাইলে স্ত্রীর ইদ্দত অতিবাহিত হওয়ার পর অন্যত্র তার বিয়ে হওয়া এবং সে স্বামীর সাথে তার মিলন হওয়া অপরিহার্য। এরপর কোনো কারণে সে তালাকপ্রাপ্তা হলে কিংবা স্বামীর মৃত্যু হলে ইদ্দত পালনের পর এরা দুজন পরস্পর সম্মত হলে নতুন করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। 
এজন্য শরীয়ত আগেই সাবধান করে দিয়েছে যে, প্রথমত তালাকের কথা চিন্তাও করবে না। তবে অতীব প্রয়োজনে কখনো তালাক প্রদানের প্রয়োজন হলে শুধু সাদামাটা তালাক দাও, শুধু এক তালাক। যেন উভয়ের জন্যই নতুন করে চিন্তা-ভাবনার সুযোগ থাকে এবং পুনরায় ফিরে আসার পথ খোলা থাকে। এরপর আবারো কোনো সমস্যা দেখা দিলে এভাবেই শুধু এক তালাক দিবে। এখনও ফিরে আসার পথ খোলা থাকবে।
কিন্তু এরপর যদি আবার কখনো শুধু এক তালাকই দেওয়া হয় এবং সব মিলে তিন তালাক হয়ে যায় এ অবস্থায় আর তাকে ফিরিয়ে আনারও সুযোগ থাকবে না, নতুন করে বিয়ে করার বৈধতাও বাকি থাকবে না।
আজকাল স্বামী-স্ত্রী তালাকের বিধান জানা ও সে অনুযায়ী আমল করার পরিবর্তে নিজেদের মনে এমনসব ভুল ও বানোয়াট মাসআলা স্থির করে রাখে যে, আল্লাহ মাফ করুন।
১. তিন তালাক ছাড়া কি তালাক হয় না
যেমন, কেউ মনে করে যে, শুধু এক বা দুই তালাক দেওয়ার দ্বারা তো তালাকই হয় না। তালাকের জন্য একসাথে তিন তালাক দেওয়াকে তারা অপরিহার্য মনে করে।
মনে রাখবেন, এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। তালাক দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি হল, শুধু এক তালাক দেওয়া। পরবর্তীতে আবারও প্রয়োজন হলে শুধু এক তালাকই দিবে। এরচেয়ে বেশি দিবে না। কিন্তু তিন তালাক দিয়ে ফেললে তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক বহাল রাখার সকল পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
একই মজলিসে কিংবা একই শব্দে তিন তালাক দেওয়া হারাম ও কবীরা গুনাহ। কিন্তু কেউ এমনটি করলে তালাক কার্যকর হবে এবং তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে যাবে।
২. তালাকের সাথে কি বায়েন শব্দ ব্যবহার করা জরুরি
অনেকে মনে করে, শুধু তালাক বললে তালাক হয় না; বরং তালাকের সাথে বায়েন শব্দও যোগ করা অত্যাবশ্যক।
এটিও ভুল ধারণা। শুধু তালাক শব্দ দ্বারাই তালাক হয়ে যায়। এর সাথে বায়েন শব্দ যোগ করার কোনো প্রয়োজন নেই। উপরন্তু এ শব্দের সংযোজন নাজায়েয। তবে কেউ যদি এক তালাক বায়েন বা দুই তালাক বায়েন দেয় তবে সে মৌখিকভাবে রুজু করার (পুনরায় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার) পথ বন্ধ করে দিল। এখন শুধু একটি পথই খোলা আছে। আর তা হল, নতুনভাবে শরীয়তসম্মত পন্থায় বিবাহ দোহরানো। অথচ শুধু তালাক বললে এক তালাক বা দুই তালাক পর্যন্ত মৌখিক রুজুর পথ খোলা থাকে। এজন্য স্বামীর উচিত, যত উত্তেজিতই হোক না কেন, কোনো অবস্থাতেই যেন তিন তালাক না দেয়। এমনকি তা কখনো মুখেও না আনে। অথচ অনেকে তো তিন তালাক দেওয়ার পরও পৃথকভাবে বায়েন শব্দ যোগ করেন। যেন সব কটি তালাক দেওয়ার পরও তার মন ভরল না। না হলে তিন তালাক দেওয়ার পর আর কী বাকি থাকে যে, বায়েন শব্দ বলতে হবে?!
মনে রাখবেন, তিন তালাক দেওয়াই এক গুনাহ, এরপর বায়েন শব্দ যোগ করে সে আরো বেশি গুনাহগার হল।
৩. একসাথে তিন তালাক দিলে কি তালাক হয় না
অনেকে এই ভুল ধারণাও প্রচার করে রেখেছে যে, একসাথে তিন তালাক দেওয়া হলে তালাক হয় না কিংবা শুধু এক তালাক হয়।
এটিও একটি মারাত্মক ভুল। একসাথে তিন তালাক দেওয়া জায়েয না হলেও কেউ যদি এই নাজায়েয কাজ করে তাহলে তার স্ত্রীর উপর তিন তালাক ঠিকই পতিত হয়। এক্ষেত্রে তার মৌখিকভাবে রুজু করার অধিকার অবশিষ্ট থাকে না। এমনকি নতুন করে বিবাহ দোহরিয়ে নেওয়ার দ্বারাও তারা একে অপরের জন্য হালাল হতে পারে না। তাই সকল স্বামীরই কর্তব্য, প্রথম থেকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা। মুখ দিয়ে কখনো তিন তালাক কিংবা তালাক, তালাক, তালাক শব্দ উচ্চারণ না করা। আর আগেই দুই তালাক দিয়ে থাকলে এখন আর তৃতীয় তালাকের চিন্তাও না করা।
৪. গর্ভাবস্থায় তালাক দিলে কি তালাক পতিত হয় না
অনেকে এই মাসআলা বানিয়ে রেখেছে যে, গর্ভাবস্থায় স্ত্রীকে তালাক দেওয়া হলে তা কার্যকর হয় না। এটিও সম্পূর্ণ অবাস্তব কথা। গর্ভাবস্থায় হোক বা অন্য যেকোনো অবস্থাই হোক তালাক দেওয়া হলে তা পতিত হয়ে যায়। এজন্য সঠিক মাসআলা শেখা সকলের দায়িত্ব। অজ্ঞতার ধোকায় থাকার কারণে হারাম কখনো হালাল হতে পারে না।
৫. তালাক পতিত হওয়ার জন্য কি সাক্ষীর উপস্থিতি জরুরি
অনেকের ধারণা, স্বামী তালাকের সময় কোনো সাক্ষী না রাখলে তালাক পতিত হয় না। আগেরটার মতো এটাও মানুষের মনগড়া মাসআলা। কোন মূর্খ এই কথা বলেছে জানা নেই। সাক্ষীর প্রয়োজন তো হয় বিবাহের সময়। তালাক পতিত হওয়ার জন্য এক বা একাধিক কোনো সাক্ষীরই প্রয়োজন নেই। স্বামী যদি রাতের অন্ধকারে একা একা বসে তালাক দেয় তাহলেও তালাক হয়ে যায়।
৬. রাগের অবস্থায় তালাক দিলে কি তালাক হয় না
তালাক তো দেওয়াই হয় রাগ হয়ে। কয়জন আছে, শান্তভাবে তালাক দেয়? আসলে তো এমনই হওয়া উচিত ছিল যে, যদি বাস্তবসম্মত ও অনিবার্য প্রয়োজনে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয় তাহলে বড়দের সঙ্গে পরামর্শ করে একে অন্যের কল্যাণকামী হয়ে বুঝে-শুনে, সঠিক মাসআলা জেনে নিয়ে মাসআলা অনুযায়ী তালাক প্রদানের মাধ্যমে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে।
 কিন্তু আফসোস! অধিকাংশ মানুষ মাসআলা জানার চেষ্টাও করে না, আর না তাদের মধ্যে এই সুবুদ্ধি আছে যে, বড়দের সাথে পরামর্শ করবে, চিন্তা-ভাবনা করবে। নিজের ইচ্ছাবিরোধী কোনো কিছু পেলেই রাগের বশে তালাক দিয়ে ফেলে। আর তা এক বা দুইটি নয়; এক নিঃশ্বাসে তিন তালাক।
যখন রাগ প্রশমিত হয় তখন অনুতপ্ত হয় এবং বিভিন্ন ধরনের কথা বানাতে থাকে। বলে, আমি রাগের মাথায় বলে ফেলেছি, তালাক দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না। এসব লোকের জেনে রাখা উচিত যে, তালাক পতিত হওয়ার জন্য নিয়তের কোনো প্রয়োজন নেই। এটা কোনো ইবাদত নয় যে, এর জন্য নিয়ত করতে হবে। নিয়ত থাক বা না থাক সর্বাবস্থায় তালাক শব্দ বলে ফেললে বা কাগজে লিখে দিলেই তালাক হয়ে যায়। তেমনিভাবে রাগের অবস্থায় তালাক দিলেও তালাক হয়ে যায়, এমনকি হাস্যরস বা ঠাট্টাচ্ছলে তালাক দিলেও তা পতিত হয়ে যায়।
অবশ্য কেউ যদি প্রচন্ড রেগে যায় ও রাগের ফলে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আর এ অবস্থায় সে কী বলেছে তার কিছুই মনে না থাকে তাহলে ঐ অবস্থার তালাক কার্যকর হবে না।
শেষকথা এই যে, দাম্পত্য জীবন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অনেক বড় ও বিশেষ একটি নেয়ামত। স্বামী-স্ত্রী সকলের কর্তব্য, এই নেয়ামতের যথাযথ মূল্যায়ন করা এবং একে অপরের সকল অধিকার আদায় করা। স্ত্রীর জন্য উচিত নয়, কথায় কথায় স্বামীর কাছে তালাক চাওয়া। আবার স্বামীর জন্যও জায়েয নয় আল্লাহ তাআলার দেওয়া ক্ষমতার অপব্যবহার করা।
বিয়ে, তালাক ও দাম্পত্য জীবনের সকল বিধান ও মাসআলা শিক্ষা করা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য জরুরি। বিশেষ করে স্বামীর কর্তব্য হল, তালাকের মাসআলা ও এর পরিণতি সম্পর্কে অবগত না হয়ে মুখে কখনো তালাক শব্দ উচ্চারণ না করা। আর যদি কোনো কারণে তালাক দেয় এবং এমনভাবে দেয় যে, এখন আর তাদের একসাথে থাকা শরীয়তে বৈধ নয় তাহলে তাদের আল্লাহকে ভয় করা উচিত। বিভিন্ন টাল-বাহানা, অজুহাতের আশ্রয় নিয়ে কিংবা ভুল কথার উপর ভিত্তি করে অথবা মূল ঘটনা গোপন রেখে একসাথে বাস না করা উচিত। বিয়ে শুধু একটি সময়ের বিষয় নয়, সারা জীবনের বিষয়।
বাস্তবেই যদি তালাক হয়ে যায় এবং শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈবাহিক সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় এরপরও স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একসাথে বাস করে তাহলে তা হবে কবীরা গুনাহ এবং উভয়েই যেন ব্যভিচারের গুনাহয় লিপ্ত।
আল্লাহ তাআলা সকলকে হেফাযত করুন এবং তাকওয়া ও পবিত্রতা দান করুন। আমীন। 

Thursday, November 27, 2014

বিয়ের বিষয়ে ইসলাম কি বলে!


১. হজরত আবু নাজি (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে কারিম (সা.) বলেন, 'তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বিয়ের সামর্থ্য রাখে, অথচ বিয়ে করে না, তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।' (আত তারগিব)

২. হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'যখন কোনো বান্দা বিয়ে করল তখন তার দ্বীনদারির (ধর্মপালনের) অর্ধেক পূর্ণ করল। এখন বাকি অর্ধেকের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় পাওয়া প্রয়োজন।' (আত তারগিব)

৩. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'হে যুবকরা! তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি স্ত্রীর ভরণপোষণ দানে সক্ষম, তার বিয়ে করে নেওয়া উচিত। কেননা বিয়ে দৃষ্টি অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থান পবিত্র রাখে। আর যে ভরণপোষণ দানে সক্ষম নয়, সে যেন রোজা রাখে। কেননা রোজা তার জন্য পৌরুষহীনতার মতো (উত্তেজনা প্রশমিত করে)।' (মেশকাত শরিফ, ইমদাদুল ফতোয়া : খণ্ড ২, পৃষ্ঠা : ২৫৮)

৪. হজরত আবু নাজি (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মুখাপেক্ষী! মুখাপেক্ষী! ওই পুরুষ, যার স্ত্রী নেই। সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, যদি তার অনেক সম্পদ থাকে, তবুও কি সে মুখাপেক্ষী? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'যদিও তার অনেক সম্পদ থাকে, তবুও সে মুখাপেক্ষী। তিনি আরো বলেন, মুখাপেক্ষী! মুখাপেক্ষী ওই নারী, যার স্বামী নেই। সাহাবিগণ জিজ্ঞেস করলেন, যদি তার অনেক সম্পদ থাকে, তবুও কি সে মুখাপেক্ষী? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'যদিও তার অনেক সম্পদ থাকে, তবুও সে মুখাপেক্ষী।" (রাজিন) কেননা সম্পদের উপকারিতা, প্রশান্তি বা পার্থিব চিন্তামুক্ত সেই পুরুষের ভাগ্যে জুটে না, যার স্ত্রী নেই। সে নারীর ভাগ্যেও জুটে না, যার স্বামী নেই। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, বিয়েতে জাগতিক ও পরকালীন অনেক বড় বড় উপকার রয়েছে। (হায়াতুল মুসলিমিন; পৃষ্ঠা : ১৮৭)

বিয়ে আল্লাহর বিশেষ দান বা উপহার। বিয়ের দ্বারা জাগতিক ও ধর্মীয় জীবন দুটোই ঠিক হয়ে যায়। মন্দ চিন্তা ও অস্থিরতা থাকে না। সবচেয়ে বড় উপকার হলো, অঢেল পুণ্য অর্জন। কেননা স্বামী স্ত্রী একত্রে বসে ভালোবাসার কথা বলা, খুনসুটি করা নফল নামাজ পড়ার চেয়েও পুণ্যময়। (বেহেশতি জেওর)

৫. হজরত আয়েশা (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'নারীকে বিয়ে করো, সে তোমার জন্য সম্পদ টেনে আনবে।' এখানে সম্পদ টেনে আনার উদ্দেশ্য হলো, স্বামী-স্ত্রী দুজনই জ্ঞানসম্পন্ন এবং একে অপরের কল্যাণকামী হয়ে থাকে। স্বামী এ কথা স্মরণ রাখে- আমার দায়িত্ব খরচ বেড়ে গেছে; তখন বেশি বেশি উপার্জন করার চেষ্টা করে। নারীও এমন কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যা পুরুষ গ্রহণ করতে পারে না। ফলে তারা প্রশান্তি ও চিন্তামুক্ত হতে পারে। আর সম্পদের মূল উদ্দেশ্যই এটি। (হায়াতুল মুসলিমিন)

৬. হজরত মাকাল ইবনে ইয়াসার (রাযি.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, 'তোমরা অধিক সন্তান প্রসবকারী নারীকে বিয়ে করো। কেননা আমি তোমাদের আধিক্যতা দ্বারা অন্যান্য উম্মতের ওপর গর্ব করব যে, আমার উম্মত এত বেশি!' [আবু দাউদ ও নাসায়ি শরিফ]

৭. হজরত আবু জর গিফারি (রাযি.) থেকে এক দীর্ঘ হাদিসে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) আক্কাফ (রাযি.)-কে বলেন, হে আক্কাফ! তোমার স্ত্রী আছে? তিনি বললেন, 'না।' রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, 'তোমার কি সম্পদ ও সচ্ছলতা আছে? তিনি বললেন, 'আমার সম্পদ ও সচ্ছলতা আছে।' রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, 'তুমি এখন শয়তানের ভাইদের দলভুক্ত। যদি তুমি খ্রিস্টান হতে তাদের রাহেব (পাদ্রী) হতে। নিঃসন্দেহে বিয়ে করা আমাদের ধর্মের রীতি। তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি হলো যে অবিবাহিত। তোমরা কি শয়তানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাও? শয়তানের কাছে নারীর চেয়ে ভয়ংকর কোনো অস্ত্র নেই। যা ধর্মভীরু মানুষের ওপরও কার্যকর। তারাও নারীসংক্রান্ত ফেতনায় জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু যারা বিয়ে করেছে, তারা নারীর ফেতনা থেকে পবিত্র। নোংরামি থেকে মুক্ত।'
এরপর বললেন, 'আক্কাফ! তোমার ধ্বংস হোক। তুমি বিয়ে করো, তা না হয় তুমি পশ্চাৎপদ মানুষের মধ্যে থেকে যাবে।' (মুসনাদে আহমাদ, জামেউল ফাওয়ায়েদ, ইমদাদুল ফতোয়া : খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৫৯)

বিয়ে একটি ইবাদত ও ধর্মীয় বিষয় যে কাজের প্রতি রোজ তাকিদ দেওয়া হয়েছে তথা ওয়াজিব; অথবা যে কাজে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে তথা মসতাহাব; বা যে কাজের বিনিময়ে সওয়াব প্রদানের অঙ্গীকার এসেছে, তা ধর্মীয় কাজ। আর যে কাজের ব্যাপারে এমনটি বলা হয়নি, তা জাগতিক কাজ। এই ভিত্তিতে পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হবে, বিয়ে ধর্মীয় কাজ। কেননা শরিয়ত কখনো বিয়ের জোর তাগিদ দিয়েছে, কখনো উৎসাহ দিয়েছে, কখনো সওয়াবের অঙ্গীকার করেছে। উপরন্তু বিয়ে না করার প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করেছে। তাই বিয়ে ধর্মীয় কাজ হওয়ার প্রমাণ। এ কারণে ফকিহ বা ধর্মবেত্তা মনীষীগণ বিয়ের যে প্রকার ও বিধান বর্ণনা করেছেন, সেখানে বিয়ে মোবাহ (অর্থাৎ যা করলে পুণ্য বা পাপ কোনোটাই হয় না) হওয়ারও কোনো স্তর বর্ণনা করেননি। এটা ভিন্ন কথা যে কোনো কারণে কখনো কখনো বিয়ে করা শরিয়তের দৃষ্টিতে মাকরুহ (অনুচিত); প্রকৃতপক্ষে বিয়ে করা ইবাদত। ইবাদত বলেই ধর্মবেত্তা মনীষীগণ বিয়ে করা অন্যকে ধর্মীয় শিক্ষা দান এবং নীরবে আল্লাহর ইবাদত করার চেয়ে উত্তম বলেছেন। (ফতোয়ায়ে শামি ও ইমদাদুল ফতোয়া)

রোজা যা ইবাদত হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত; কোনো কোনো অবস্থায় তাতেও শাস্তির বিধান প্রদান করা হয়। শরিয়তের নীতি-নির্ধারকরা কাফফারার রোজার (যে রোজা পাপ মোচনের নিমিত্তে রাখতে হয়) ক্ষেত্রে যেমনটি বলেছেন। তার পরও কেউ রোজাকে জাগতিক বিষয় বলে না। তাহলে বিয়ের 'লেনদেন' বৈশিষ্ট্যের কারণে তাকে জাগতিক বিষয় বলা হবে কেন। বরং ভাবার বিষয় হলো, লেনদেনের বিপরীতে শাস্তির বিধান ইবাদতের তুলনায় অনেক দূরের। যখন ইবাদতের বিপরীতে শাস্তির বিধান আসার পরেও তা জাগতিক হয় না, তাহলে ইবাদতে (বিয়েতে) 'লেনদেন' বৈশিষ্ট্যযুক্ত হওয়ায় তা জাগতিক হয়ে যাবে না। (ইমদাদুল ফতোয়া : খণ্ড ২, পৃষ্ঠা : ২৬৮)

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন- 'আল্লাহপাক তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য জোড়া (সঙ্গী) সৃষ্টি করেছেন। যাতে তোমরা তাদের থেকে শান্তি লাভ করো। আর তিনি তোমাদের মাঝে দান করেছেন ভালোবাসা ও দয়ার্দ্রতা।'
অন্যত্র বলেন- 'তোমাদের স্ত্রীরা (সন্তান উৎপাদনের জন্য) তোমাদের ক্ষেতস্বরূপ।'

১. স্ত্রীকে বানানো হয়েছে পুরুষের আরাম ও শান্তির জন্য। বিষণ্নতা, দুশ্চিন্তা ও নানা কর্মব্যস্ততার মাঝে স্ত্রী শান্তি ও স্বস্তির মাধ্যম। মানুষ প্রাকৃতিকভাবেই ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের অনুরাগী। স্ত্রীর সঙ্গে মানুষের বিরল ও আশ্চর্য ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয়।

মেয়েরা সৃষ্টিগতভাবে দুর্বল। সন্তান প্রতিপালন, গৃহব্যবস্থাপনার দায়িত্বশীল ও সব কাজের শ্রেষ্ঠ সহযোগী। ফলে তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে হবে। স্ত্রী ইজ্জত, সম্মান, সম্পদ ও সন্তান সংরক্ষণকারী এবং এর পরিচালক। স্বামীর অনুপস্থিতিতে সে তার সম্পদ, সম্মান ও দ্বীনের সংরক্ষণ করে।

২. মানুষ সৃষ্টিগতভাবে জৈবিক চাহিদা বা কামভাবের অধিকারী। স্ত্রী পুরুষের কাম-চাহিদা পূরণ করে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'স্ত্রীরা তোমাদের ক্ষেতস্বরূপ।' তারা বীজ উৎপাদনের উপযোগী। যেভাবে ক্ষেতের সেবা-যত্ন করা হয় ও তার একটি উদ্দেশ্য থাকে। তেমনি স্ত্রীরও বিশেষ কিছু উদ্দেশ্য রয়েছে, যা থেকে উপকৃত হওয়া উচিত।

৩. নারীর প্রতি পুরুষের যে আগ্রহ ও চাহিদা রয়েছে এবং পুরুষের প্রতি নারীর যে আগ্রহ ও চাহিদা রয়েছে, তা প্রাকৃতিক। বিয়ের মাধ্যমে তা পূরণ করলে মানুষের অন্তরে প্রকৃত ভালোবাসা ও পবিত্র চিন্তা-চেতনা তৈরি হয়। আর অবৈধভাবে পূরণ করা হলে তা মানুষকে অপবিত্র জীবনের প্রতি নিয়ে যায়। অন্তরে নোংরা চিন্তা ও কল্পনা সৃষ্টি করে। সুতরাং বিয়ে পবিত্র জীবনের অনুগামী করে এবং নোংরা জীবন থেকে ফিরিয়ে রাখে। [আল মাসালিহুল আকলিয়্যা: পৃষ্ঠা : ১৯২]