বিবাহ মহান আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ নেয়ামত

হে মানব, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিতি হও। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্ভ্রান্ত যে সর্বাধিক পরহেযগার। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সবকিছুর খবর রাখেন। [সূরা আল-হুজুরাতঃ ১৩]

ঈমানদার পুরুষ ও নারীদের সম্পর্কে আল্লাহ্‌ তা'আলা পবিত্র কুরআনে বলেনঃ-

আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের সহায়ক। তারা ভাল কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবন যাপন করে। এদেরই উপর আল্লাহ তা'আলা দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশীল, সুকৌশলী। [সূরা আত-তউবাঃ ৭১]

রাসুল (সাঃ) দ্রুত বিবাহের জন্য উৎসাহ দিয়ে বললেন:

হে যুবকেরা! তোমাদের মধ্যকার যে বিবাহের সামর্থ্য রাখে সে যেন বিবাহ করে নেয়। (বুখারী-৫০৬৫)

জীবনসঙ্গী পছন্দ করার বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

“চারটি বিষয়কে সামনে রেখে মেয়েদেরকে বিয়ে করা হয় — তার ধন সম্পদ, তার বংশমর্যাদা, তার রূপ-সৌন্দর্য ও তার ধর্মপরায়নতা। এক্ষেত্রে ধর্মপরায়ন স্ত্রী লাভে বিজয়ী হও, তোমার হাত কল্যাণে ভরে যাবে।” [বুখারী ও মুসলিম]

মহানবী (স:)একদিন যুবকদের লক্ষ্য করে বলেন:

যুবকদের লক্ষ্য করে বললেন, হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যে বিয়ের সামর্থ্য রাখে সে যেন বিয়ে করে। কেননা বিয়ে দৃষ্টিকে সংযত করে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। আর যে বিয়ের যোগ্যতা রাখে না, তার উচিত রোজা পালন করা। (বোখারি ও মুসলিম)

Friday, December 26, 2014

মেয়েকে কি ইদ্দত পালন করতে হবে এবং ঐ ব্যক্তিকে কি মোহর দিতে হবে?

প্রশ্ন:
জনৈক ব্যক্তি ত্রিশ হাজার টাকা দেনমোহর ধার্য করে একটি মেয়েকে বিয়ে করে এবং তার সাথে বাসর হয়। তবে তাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী সূলভ কোনো আচরণ হয়নি। এ অবস্থায় লোকটি তাকে তালাক দেয়। জানতে চাই, মেয়েকে কি ইদ্দত পালন করতে হবে এবং ঐ ব্যক্তিকে কি মোহর দিতে হবে?

উত্তর:
প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে যেহেতু বাসর হওয়ার পর তালাক দেওয়া হয়েছে তাই মেয়েটির উপর ইদ্দত পালন করা জরুরি এবং লোকটির উপর পূর্ণ মোহর (ত্রিশ হাজার টাকা) দেওয়াও জরুরি। কেননা, ইদ্দত হওয়া এবং পূর্ণ মোহর প্রাপ্তির জন্য স্বামী-স্ত্রী সুলভ আচরণ শর্ত নয়; একত্রে নির্জন কক্ষে অবস্থানই যথেষ্ট।

মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৯/২০৬; ইলাউস সুনান ১১/৮৯; হিদায়া ২/৩৪৫; ফাতহুল কাদীর ৩/২১৬; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ২/৩৮; তাবয়ীনুল হাকায়েক ২/৫৪৬; আলমুহীতুল বুরহানী ৪/১৫১

ইদ্দতের অবস্থায় সে নাকফুল পরতে পারবে? রঙিন কাপড় পরতে পারবে? চুল আচড়াতে পারবে?

প্রশ্ন:
এক মহিলার স্বামী মারা যাওয়ায় সে ইদ্দত পালন করছে। এ অবস্থায় কি সে নাকফুল পরতে পারবে? রঙিন কাপড় পরতে পারবে? চুল আচড়াতে পারবে? একজন বললেন, চুল আচড়ানো নিষেধ। তাহলে এত লম্বা চুল না আচড়ালে তো জট বেঁধে যাবে? বিস্তারিত জানিয়ে বাধিত করবেন।

উত্তর:
স্বামী মারা গেলে স্ত্রীর জন্য ইদ্দত অবস্থায় সকল প্রকার সাজসজ্জা ত্যাগ করা জরুরি। তাই অলংকার পরা যাবে না। এমনকি নাকফুলও খুলে রাখতে হবে। আর রঙিন সাধারণ ব্যবহৃত কাপড় পরতে পারবে। সাদা কাপড় পরা বাধ্যতামূলক নয়। তবে পুরাতন কাপড় থাকলে নতুন কাপড় পরবে না। তদ্রূপ ঝলমলে কাপড় থেকেও বিরত থাকবে। সৌন্দর্যের উদ্দেশ্যে চুল আচড়াতে পারবে না। তবে চুলের স্বাভাবিকতা রক্ষা করার জন্য আচড়ানোর প্রয়োজন হলে তা পারবে। এটা নিষিদ্ধ নয়।

সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২৩০৪; মুসনাদে আহমদ ৬/৩০২; ফাতাওয়া খানিয়া ১/৫৫৪; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/৫৩৩; তাবয়ীনুল হাকায়েক ৩/২৬৬

কনের ইজিন নেওয়ার সময় বরপক্ষের উকিলের সাক্ষীস্বরূপ উপস্থিতি শরীয়তসম্মত কি না?

প্রশ্ন:
আমদের এলাকায় প্রচলন রয়েছে যে, বিয়ে উপলক্ষে কনের ইজিন নেওয়ার সময় কনের দু’জন কফিল এবং বরের দু’জন কফিল উপস্থিত থাকতে হয়। তাদের উপস্থিতিতে কোনো আলেম সাহেব খুতবা পড়ে নিয়মানুযায়ী ইজিন নেন। বরপক্ষে কফিলের উপস্থিতির কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা বলল, সাক্ষী স্বরূপ তাদের উপস্থিতি জরুরি। জানার বিষয় এই যে, কনের ইজিন নেওয়ার সময় বরপক্ষের উকিলের সাক্ষীস্বরূপ উপস্থিতি শরীয়তসম্মত কি না? ইজিন নেওয়ার সময় বরপক্ষের সাক্ষীর থাকা জরুরি কি না।

উত্তর:

মেয়ে থেকে বিয়ের ইজিন তথা অনুমতি নেওয়ার জন্য সাক্ষী থাকা অপরিহার্য নয়। একজন ব্যক্তিও মেয়ে থেকে অনুমতি নিয়ে এসে তার পক্ষ থেকে বিয়ের প্রস্তাব বা কবুল করতে পারে। অবশ্য এক্ষেত্রে সাক্ষী রাখা জরুরি নয়, তবে সাক্ষী থাকা ভালো। গায়রে মাহরাম পুরুষদের জন্য সরাসরি মেয়ে থেকে অনুমতি (ইজিন) নিতে যাওয়া বৈধ হবে না। আর ইজনের জন্য পাত্র পক্ষ থাকতেই হবে এমন কোনে আবশ্যকতা নেই।

-আলবাহরুর রায়েক ৩/৮২; রদ্দুল মুহতার ৩/২১

শ্বশুর-শাশুড়িকে আব্বা-আম্মা বলা যাবে কি?

প্রশ্ন:
শ্বশুর-শাশুড়িকে আব্বা-আম্মা বলা যাবে কি? যদি বলা যায় তাহলে ওই হাদীসের ব্যাখ্যা কী হবে, যে হাদীসে অন্যকে পিতা বলে সম্বোধন করতে নিষেধ করা হয়েছে? 

উত্তর:
হাদীসে যে অন্যকে পিতা বলে সম্বোধন করতে নিষেধ করা হয়েছে এর অর্থ বংশপরিচয় প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আসল পরিচয় গোপন রেখে নিজের পিতার নাম উল্লেখ না করে, অন্যের নাম প্রকাশ করা। যেমন-আইডি কার্ড, পাসপোর্ট, জন্মনিবন্ধন অথবা এমন কোনো দলিল বা স্থান যেখানে কোনো ব্যক্তির জন্মদাতা পিতার নাম প্রকাশ করা জরুরি হয়। আর স্বামী বা স্ত্রীর পিতা-মাতাকে সম্মানার্থে আব্বা-আম্মা বলে সম্বোধন করার দ্বারা বংশপরিচয় গোপন হয় না। তাই শ্বশুর-শাশুড়িকে আব্বা-আম্মা বলা হাদীসের নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত নয় এবং তা জায়েয।

আহকামুল কুরআন, জাসসাস ৩/৩৫৪; সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৭৬৬; ৬৭৬৮, ৪৩২৬, ৪৩২৭,৩৫০৮; উমদাতুল কারী ১৬/৭৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১২-১১৫; ইকমালুল মুলিম ১/৩১৯; তাফসীরে রূহুল মাআনী ৯/২১০; তাফসীরে কুরতুবী ১২/৬৭; ফাতহুল মুলহিম ১/২৩৬; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৯/৪৯-৫২; মুসনাদে আহমদ ১/১৭৪, ৩/৮৯; ফয়যুল কাদীর ৬/৪৬; কেফায়াতুল মুফতী ৯/১১৮

বিয়ে কি এমনই হওয়া উচিত?

ইমাম সুহাইব ওয়েব একদিন এক আলোচনায় বলেছিলেনঃ "বিয়ে ফিকহের বিষয়গুলোর মধ্যে সবচেয়ে সহজ এবং আমাদেরসংস্কৃতিতে সবচেয়ে কঠিন একটি বিষয় ।

একটা ছেলে যদি বিয়েকরতেও চায়, তার প্রতিবন্ধকতা আসে -- " তুমি তো এখনো তেমন আয় করো না "। অথচ এই আয় না করা ছেলেটা জীবনের একটা কঠিন সময় অতিক্রম করে, যদিও কোনভাবে ভয়াবহ কঠিন মুহূর্তগুলো পাশ কাটিয়ে একটা চাকুরি করে বিয়ে করতে যায়, তার সামনে কমপক্ষে একবছরের বেতনের সমান খরচের বিয়ের আয়োজনের বার্তা আসে।

আমাদের এই দেশ এখন অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু, তবু এই সমাজের মানুষগুলো বিশাল ঢাক-ঢোল আয়োজন ছাড়া বিয়ে না করলে তাকে গ্রহণকরেনা।
আরো আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, ইসলামিক [মুসলিম বলছিনা কিন্তু] অথবা নন-ইসলামিক -- যেকোন পরিবারগুলোই পৃথিবীর আর কিছু যা-ই থাক, বিয়েতে বিশাল আয়োজনের,টাকা খরচ করার, সমাজের কাছে মাথা উঁচু করে(!) তাদের খুশি করার চেষ্টাতে কিছুতেই কমতি করেনা।

মানুষের ইসলামের অনুভূতি মূলত আর্থিক অবস্থানের সাথে সাথে নিজস্ব ব্যাখ্যা পায়। যার হয়তএকটা বাড়ি থাকে, গাড়ি থাকে, হাতে কিছু মোটা অংকের ক্যাশ থাকে, তখন তার কাছে বিয়ের আদিখ্যেতা খরচ করতে নাপারাটা *ছোট মনের* বলেপ্রতীয়মান হয়।

আমাদের দেশের বিয়েগুলোতে মেয়েপক্ষ সজ্ঞানে-অজ্ঞানেছেলেপক্ষের কাছে*দায়গ্রস্ত*থাকেন, খুব প্রচলিত একটা ঘটনা হলো ফার্নিচার দেয়া।

মেয়ের বাবা যেমন অর্থ-সম্পদেরমালিকই হোন না কেন, তিনি ধার-দেনা করে মেয়ের বিয়েতে খরচ করতে মরিয়া হয়ে যান। মেয়ের সুখের জন্য তাকে যে করেই হোক জামাইকে কিছু দিতে হবে।

এখানেও যন্ত্রণা, কষ্ট, ধার-দেনা। কতরকম খোঁটা খাওয়ার ভয়! বিয়ের আয়োজনেই অস্থির অবস্থা।ওইদিকে আছে বৌভাত, হলুদ, আরো কত কী!!

আল্লাহ তো কুরআনুল কারীমে জানিয়ে দিয়েছেন আমাদেরকেঃ

[১] "কিছুতেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানেরভাই। শয়তান স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ"। [আল ইসরাঃ ২৬-২৭]

[২] "খাও ও পান কর এবং অপব্যয় করো না। তিনি অপব্যয়ীদেরকে পছন্দ করেন না"। [আল আরাফঃ ৩১]
আরো কতরকম আদিখ্যেতা বিয়ের অনুষ্ঠানে! যেগুলোর কোনটাই সুন্নাহনয়, বরং স্কলারদের মতে অনেকগুলোই নিষিদ্ধ। আঞ্চলিক কিছু প্র্যাকটিস তো বলার মতই না, এতই জঘন্য। আমার এক বোনের বিয়েতে সেই বাড়ির নিয়মানুযায়ী দুধে পা ডুবানো, আয়নায় মুখ দেখা, অনেকগুলো মিষ্টি খাওয়া -- এরকম আরো অনেকগুলো অসভ্য ঢং করার পর ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মানুষটাকে ঘুমাতে দেয়া হয় কয়েক ঘন্টা পর, মাঝরাতে পেরিয়ে গেলে। এইসব ছাড়াও সার্বজনীন আর বাহুল্য কালচার যেসব আছেঃ

*. আংটি পড়ানো

*. দামী কার্ড ছাপানো,

*. শুধু শুধু বা আভিজাত্য জাহিরের জন্য দামী কমিউনিটি সেন্টার/হোটেল ইত্যাদি ভাড়া করা,

*. শুধু মাত্র বিয়ের দিনের জন্য দামী পোশাক কেনা যা আর কখনও পড়া হয় না

*. গায়ে হলুদ

*. কনের/বরের সাজসজ্জায়অপ্রয়োজনীয় খরচ।

*. অনুষ্ঠানে নারী পুরুষ একসাথে অবাধে মেলামেশার সুযোগ, নাচ-গানের আয়োজন

*. গেটে টাকার জন্য বর-কনেদের বিব্রত করা, বাদানুবাদ

*. বিয়ের দিনে সাজুগুজুআর অতিথি আপ্যায়ন করতে গিয়ে নামায না পড়া
অথচ আল্লাহর দ্বীন হলো একদম সহজ। বিয়েতে কথা তোলার জন্য দরকার হয় একজন ওয়ালী, যিনি হবেন মেয়ের বাবা/অভিভাবক। তিনি মেয়ের মত নিয়ে কথা বলবেন ছেলের সাথে। মুহর ঠিক হবে যার সুন্নাহ হচ্ছে পুরোটাই কনেকে পরিশোধ করে দিবে বর বিয়ের আগেই, তবে যদিবা না পারে, তবে পরে দিতে পারবে যদি কনে তাতে অনুমুতি দেয়। এই মুহর থেকে কোন অংশ সাংসারিক কাজে ব্যয় করতে বলতে পারবে না ছেলে। এই টাকা একান্তই মেয়েটার।

আমাদের দ্বীনে মেয়ের/মেয়েপক্ষের বলতে গেলে কোনই খরচ নেই একটা বিয়েতে। কিন্তু আমাদের সমাজে প্রচলিত যত বোঝা, তার সমস্ত কিছুই আমরা নিয়ে এসেছি অন্য ধর্মের সংস্কৃতি থেকে। একইভাবেএকটা বিয়েতে যত কম খরচ হয়, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে সেই বিয়ে বেশি পছন্দের। আমরা কি আল্লাহর পছন্দের বান্দাহতে চাই, নাকি সমাজের দাস?

আমাদের আদর্শ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

[৩] "সবচাইতে নিকৃষ্ট খাদ্য হচ্ছে সেই ওয়ালিমাহ এর খাদ্য যেখানে কেবল ধনীরাই নিমন্ত্রন পায়, গরীবেরা নয়"। [সহীহ বুখারী]

[৪] "সবচাইতে উত্তম বিয়ে হচ্ছে সহজতম বিয়ে(মোহরানার দিক থেকে)"।[ইবন মাজাহ, আবু দাউদ]
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ হচ্ছে দ্বীনদারীর যোগ্যতা দেখে জীবনসঙ্গী বাছাই করে বিয়ে করা। জীবনের সাথী হতে হবে এমন একজন মানুষ যিনি আল্লাহকে ভয় করেন। কোনকিছুতে আল্লাহও তার রাসূলের নির্দেশ পাওয়ামাত্র যিনি মেনে নিবেন, শুধরে নিবেন নিজেকে। সংসার জীবনে কীভাবে আর দ্বিমত হবে, মনোমালিন্য হবে যখন কুরআন আর সুন্নাহ মানতে আগ্রহী দু'জনেই? বরং তারা আজীবন আল্লাহকে ভালোবেসেই নিজেদের আঁকড়ে ধরে থাকবে এই দুনিয়া ছাপিয়ে অনন্ত জীবনের সঙ্গী হবার স্বপ্নে।

আল্লাহর নির্দেশ তো অনুপম, তার পালনকারীও হবেন সেরা মানুষ! হতে পারি আমরা জীবনে অনেক ভুল করেছি, এখন চাইলেই নিজেদের শুধরে নিতে পারি। কিন্তু আল্লাহর নির্দেশকে এড়িয়ে যেতে চাইলে, নিজেদের মতন চলতে চাইলে সেটা কি আল্লাহর দাসত্ব করা হয়? নাকি নিজের নফসের?

আল্লাহ যে রাহমানুর রাহিম, সেইটার অনুধাবন করতে অনেক জ্ঞানী হতে হয়না। এই কঠিন আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থার সময়েচারপাশে তাকালেই বোঝা যায়। আল্লাহ তার অনন্ত ভালোবাসা আর রাহমাতের হাত তিনি প্রশস্ত করে দেন সবাইকেই। সবাই নিজ নিজ ব্যাখ্যা দিয়ে জীবন পরিচালিত কতে পারে, নিজেকে নিয়ে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে পারে।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, আখিরাতে আল্লাহর বিচার যে অনেক সূক্ষ্ম হবে। কেউ ছাড় পাবেনা একটুও। কিছুতেই না। আর সেই ছাড় না পাওয়াটা যে আসলেই সবচাইতে সুন্দরতম জিনিস-- সেই উপলব্ধিটা প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতায় মোহাচ্ছন্ন অমানুষদের আচরণ, কাজ দেখলে অনুভব করি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা আমাদেরকে তাঁর নির্দেশনা মেনে দুনিয়াতে চলার তাওফিক দান করুন, অতীতের ভুলগুলোর তাওবা করে তার পথে ফিরে আসার তাওফিক দিন, আখিরাতের অনন্ত জীবনে মুক্তি পাওয়ার যোগ্য করে দিন। আমিন।


(সংগ্রহ)

Wednesday, December 24, 2014

জীবনসঙ্গিনী কেমন হওয়া চাই

মানবজীবনের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য পরিবার অপরিহার্য। নারী ও পুরুষের সমন্বয়ে গড়া হয়েছে মানবসমাজ। আর নারীর প্রবল আকর্ষণ প্রকৃতিগত করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন মানব কুলকে মোহগ্রস্ত করেছে নারী, সন্তানসন্ততি, রাশিকৃত স্বর্ণ-রৌপ্য, চিহ্নিত অশ্ব, গবাদি পশুরাজি এবং ক্ষেত-খামারের মতো আকর্ষণীয় বস্তুসামগ্রী। এ সবই হচ্ছে পার্থিব জীবনের ভোগবস্তু। আর আল্লাহর কাছেই হলো উত্তম আশ্রয়।’ (সূরা ইমরান : ১৪)। 

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অকৃত্রিম মিলনই হলো তাদের প্রাকৃতিক দাবি। এ মিলন যদি হয় লাগামহীন পন্থায় তবে সমাজ ও সভ্যতায় বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়াই অবধারিত। বস্তুত আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-পন্থা অনুযায়ী নারী-পুরুষের সঠিক সম্পর্কের ওপরই নির্ভর করে সমাজ ও সভ্যতার সুস্থতা ও নিরাপত্তা। আর তাদের উভয়ের মধ্যে খোদায়ী বিধি অনুযায়ী এ সম্পর্ক কেবল বিয়ের মাধ্যমেই হতে পারে। বিয়ের মাধ্যমে নারী ও পুরুষের মধ্যে যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তাতে সূচনা হয় তাদের পারিবারিক জীবনের। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: বলেন, একদা নবী করিম সা: যুবকদের লক্ষ্য করে বললেন, হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যে বিয়ের সামর্থ্য রাখে সে যেন বিয়ে করে। কেননা বিয়ে দৃষ্টিকে সংযত করে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। আর যে বিয়ের যোগ্যতা রাখে না, তার উচিত রোজা পালন করা। (বোখারি ও মুসলিম)। 

পারিবারিক জীবন ছাড়া মানুষের দাম্পত্য জীবন কোনো অবস্থাতেই সুখের হতে পারে না। অতঃপর তাদের থেকে জন্ম নেয় সন্তানসন্ততি। সন্তান লালনপালন ও সুশিক্ষার জন্য পারিবারিক জীবন অপরিহার্য। মাতৃক্রোড়কে বলা হয়েছে শিশুর প্রথম বিদ্যালয়। আল্লাহ তায়ালা প্রেমপ্রীতি, ভালোবাসা, দয়া, স্নেহ, সহানুভূতি মানুষের প্রকৃতিজাত করে দিয়েছেন। সন্তানের প্রতি পিতামাতার স্নেহ, দয়া এবং পিতামাতার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা, আর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার প্রেমপ্রীতি মানুষের চিরন্তন প্রকৃতিজাত নিয়ম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্য তোমাদেরই যুগল থেকে তোমাদের পুত্র ও পৌত্রাদি দিয়েছেন এবং তোমাদের উত্তম জীবনোপকরণ দান করেছেন। অতএব, তারা কি মিথ্যা বিষয়ে বিশ্বাস স্থাপন করে এবং আল্লাহর অৃনুগ্রহ অস্বীকার করে?’ (সূরা নাহল : ৭২)। 

আদর্শ গৃহ গড়ার প্রথম সোপান হলো, এ গৃহের জন্য আদর্শময়ী সতী-সাধ্বী স্ত্রী নির্বাচন করা। তাই দাম্পত্য জীবন আরম্ভের প্রাক্কালেই সহধর্মিণীর দ্বীনদারিতা ও ধার্মিকতা দেখে নেয়া একান্ত জরুরি। আল্লাহর রাসূল সা: বলেন, এমন সতী-সাধ্বী স্ত্রী বরণ করা উচিত, যে তোমাকে তোমার দ্বীন ও দুনিয়ার বিষয়ে সাহায্য করে; যা সব সম্পদ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।’ রাসূল সা: অন্যত্র বলেন, ‘পুণ্যময়ী ও অধিক সন্তানপ্রসূ নারীকে বিয়ে করো। কেয়ামতে তোমাদের সংখ্যাধিক্য নিয়ে সব আম্বিয়ার কাছে আমি গর্ব করব।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৩/২৪৫)। 

সতী ও সাধ্বী পাত্রী যেমন পুরুষের জন্য বিরাট সৌভাগ্যের বিষয় তেমনি অসতী পাত্রী তার পক্ষে বড় দুর্ভাগ্যের বিষয়। আল্লাহর রাসূল সা: বলেন, ‘সতী স্ত্রী এক সৌভাগ্যের সম্পদ; যাকে তুমি দেখে পছন্দ করো এবং যে তোমার মন মুগ্ধ করে, আর তোমার অবর্তমানে তার ব্যাপারে ও তোমার সম্পদের ব্যাপারে সুনিশ্চিত থাকে। পক্ষান্তরে অসতী স্ত্রী দুর্ভাগ্যের আপদ; যাকে দেখে তুমি অপছন্দ করো এবং যে তোমার মন মুগ্ধ করতে পারে না। যে তোমার ওপর মানুষের হামলা চালায়। আর তোমার অনুপস্থিতিতে তার ও তোমার সম্পদের ব্যাপারে সুনিশ্চিত হতে পারে না।’ (সিলসিলা সহিহা ১৮২, ইবনে হিব্বান)। 

অন্যথায় তার সোনার সংসারে সুখের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। আল্লাহর নবী সা: বলেন, ‘যার দ্বীন ও চরিত্র তোমাদের মুগ্ধ করে, তার সাথে (তোমাদের ছেলেদের কিংবা মেয়েদের) বিয়ে দাও। যদি তা না করে (শুধু দ্বীন ও চরিত্র দেখে তাদের বিয়ে না দাও বরং দ্বীন বা চরিত্র থাকলেও শুধু বংশ, রূপ বা ধন-সম্পত্তির লোভে বিয়ে দাও) তবে পৃথিবীতে বড় ফিতনা ও মস্ত ফাসাদ, বিঘ্ন ও অশান্তি সৃষ্টি হবে।’ (ইবনে মাজাহ -১৯৭)।
আল্লাহ পাক কুরআনে বলেছেন, তোমরা বিয়ে করো যাদের তোমাদের ভালো লাগে (সূরা মায়িদা : ৪)। 
এর অর্থ হলো, বিয়ে-ইচ্ছুক ব্যক্তি যেন তার ভালোলাগা বৈধ নারীকে বিয়ে করে। (তাফসির আর-রাজি : ৯/১৭১)। 
আশ-শাওকানি রা: বলেছেন, যেসব নারীর প্রতি তোমাদের চিত্ত আকৃষ্ট হয় এবং যেসব নারী তোমাদের মনঃপূত হয় তোমরা তাদের বিয়ে করো (ফাতহুল কাদির : ১/৪৪৯)।

মুহাম্মাদ ইবনে মুসলিমা রা: থেকে বর্ণিত রাসূল সা: বলেছেন, যখন মহীয়ান গরীয়ান আল্লাহ কোনো পুরুষের অন্তরে কোনো নারীর বিয়ের প্রস্তাব জাগরূক করে তখন তাকে দেখেশুনে যাচাই-বাছাই করা দোষনীয় নয়। (ইবনে মাজাহ : ১৮৬৪)। 
রাসুলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যখন তোমাদের কেউ নারীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় তখন সে যেন তার এমন কিছু দেখে, যা তাকে তার সাথে বিয়েতে উৎসাহিত করে’ (আবু দাউদ : ২০৮২)। 
কনেকে একবার দেখে পছন্দ করা গেলে একবার দেখাই বিধান। কোনো কোনো নারীকে একবার দেখে তার সাথে বিয়ের মতো গুরত্বপূর্ণ চুক্তির সিদ্ধান্ত নেয়া য়ায় না। এ ক্ষেত্রে তাকে একাধিকবার দেখা বিহিত। ফিকহের ভাষ্য হচ্ছে, পাত্রের জন্য বিহিত পাত্রীকে বারবার দেখা, এমনকি যদি সে উক্ত পরিস্তিতিতে তিনবারের বেশিও দেখে যাতে তার সামগ্রিক বিষয়টি পাত্রের কাছে সুস্পষ্ট প্রতিভাত হয় (আর-রামলি, নেহায়া : ৬/১৮৬)। 
যদি পাত্র পাত্রীকে একবার দেখেই পরিতৃপ্ত হয়ে যায়, তবে তার জন্য একবারের অতিরিক্ত দেখা হারাম। কারণ এই দেখা হালাল করা হয়েছে অনিবার্য প্রয়োজনে। সুতরাং এখানে অনিবার্য প্রয়োজন বিবেচ্য (রাদ্দুল মুহতার : ৬/৩৭০)।

Tuesday, December 23, 2014

সমস্ত বিবাহিত ভাইদের জন্য

স্ত্রী কে ভালবাসুন…যখন সে আপনার চায়ে ছোট একটি চুমুক দেয়। কারণ, সে নিশ্চিত হতে চায় চা টি আপনার পছন্দ মত হয়েছে কিনা।

স্ত্রী কে ভালবাসুন…যখন সে আপনাকে নামাজ পড়তে জোর করে। কারণ সে আপনারই সাথে জান্নাতে যেতে চায়।

স্ত্রী কে ভালবাসুন…যখন সে আপনাকে সন্তানদের সাথে খেলা করতে বলে। কারণ সন্তানদের অভিভাবক সে একা নয়।

স্ত্রী কে ভালবাসুন…যখন সে আপানাকে নিয়ে ঈর্ষান্বিত হয়। কারণ, সে অন্য সমস্ত মানুষকে রেখে শুধুমাত্র আপনাকেই বেঁছে নিয়েছে।

স্ত্রী কে ভালবাসুন…যখন তার কিছু দোষ ত্রুটি আপনাকে বিরক্ত করে। কারণ, আপনারও এমন অনেক দোষ ত্রুটি রয়েছে।

স্ত্রী কে ভালবাসুন…যখন তার রান্না খারাপ হয়। কারণ, সে ভাল রান্নার চেষ্টা করেছে।

স্ত্রী কে ভালবাসুন…যখন সকাল বেলায় তাকে উষ্কখুষ্ক দেখায়। কারণ, সে আবার আপানরই জন্য সাজগোজ করবে।

স্ত্রী কে ভালবাসুন…যখন সে আপনাকে সন্তানের লেখাপড়ায় সাহায্য করতে বলে। কারণ সে চায় আপনাকে সংসারের অংশ হিসেবে পেতে।

স্ত্রী কে ভালবাসুন…যখন সে জানতে চায় তাকে মোটা লাগছে কিনা। কারণ, আপনার মতামত তার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ; এজন্য তাকে বলুন সে সুন্দর।

স্ত্রী কে ভালবাসুন…যখন তাকে সুন্দর দেখায়। কারণ সে আপনারই, তাই প্রশংসা করুন।

স্ত্রী কে ভালবাসুন…যখন সে তৈরি হতে দীর্ঘ সময় পার করে দেয়। কারণ সে চায় তাকে আপনার চোখে সবচেয়ে সুন্দর লাগুক।

স্ত্রী কে ভালবাসুন…যখন সে এমন কোন উপহার দেয় যা আপনার পছন্দ হয়নি। কারণ সে আপনাকে খুশি করতে চায়, তাই তাকে বলুন, ঠিক এমন উপহারই আপনার প্রয়োজন ছিল।

স্ত্রী কে ভালবাসুন…যখন তার মধ্যে কোন বদঅভ্যাস গড়ে ওঠে। কারণ আপনারও এমন অনেক বদঅভ্যাস রয়েছে; প্রজ্ঞা আর কোমলতার সাথে তার সেই বদঅভ্যাস পরিবর্তন করানোর সময় এখনো আপনার আছে।

স্ত্রী কে ভালবাসুন…যখন সে অকারণেই কাঁদে। তাকে বলুন সব ঠিক হয়ে যাবে।

স্ত্রী কে ভালবাসুন…যখন সে PMS বা মাসিক অবসাদ এ ভোগে। তার জন্য চকলেট আনুন, তার পায়ের পাতায় ও কোমরে মালিশ করে দিন, এবং তার সাথে নিছকই গল্প করুন (বিশ্বাস করুন এতে কাজ হয়!)

স্ত্রী কে ভালবাসুন…যদি সে অসন্তোষজনক কিছু করে ফেলে। এরকম হতেই পারে এবং এর রেষ একসময় কেটেও যাবে।

স্ত্রী কে ভালবাসুন…যখন সে আপনার কাপড়ে ভুলবশতঃ দাগ লাগিয়ে ফেলে। একটি নতুন জামা আপানি এমনিতেও কিনতেন।

স্ত্রী কে ভালবাসুন…যখন সে আপনাকে বলে আপনার কিভাবে ড্রাইভ করা উচিৎ। সে শুধু চায় আপনি নিরাপদে থাকুন।

স্ত্রী কে ভালবাসুন…যখন সে তর্ক করে। সে তাই চায় যা আপানাদের দুইজনের জন্যই ভাল হয়।

স্ত্রী কে ভালবাসুন…সে শুধু আপনারই। এটি ছাড়া তাকে ভালবাসার অন্য কোন বিশেষ কারণেরও প্রয়োজন নেই!!!

এই সবই নারীসুলভ স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। আর স্ত্রী আপনার জীবনেরই একটি অংশ যাকে রানীর মত মর্যাদা দেওয়া উচিৎ।

উকিল বাবার সাথেও পর্দা করা জরুরি

মানবজীবনে পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের গুরুত্ব অপরিসীম। পাত্র-পাত্রীর মাঝে অসামঞ্জস্যতা বিয়ে-পরবর্তী দাম্পত্য জীবনে নানা সঙ্কট সৃষ্টি করে। অনেক সময় সে সঙ্কট নিরসন করা সম্ভব হয় না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান ও অসামঞ্জস্যতা অনেক ক্ষেত্রে বিয়ে বিচ্ছেদেরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই ইসলাম পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে, যাতে বিয়ে করে মানুষ অতৃপ্তিতে না ভোগে এবং বিয়ের মতো একটি পবিত্র ও ধর্মীয় বন্ধন সারা জীবন অটুট থাকে। পাত্র-পাত্রীর মাঝে সামঞ্জস্যতা দাম্পত্য জীবনে এনে দেয় স্বস্তি ও প্রশান্তি। এই প্রশান্তিই নর-নারীকে সাহায্য করে যাবতীয় পাপাচার থেকে দূরে থেকে নিজেদের চারিত্রিক পবিত্রতা অক্ষুণœ রাখতে। হাদিস শরিফে আছে, ‘হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বললেন, আমি এক আনসারী মেয়েকে বিয়ে করতে চাচ্ছি। নবী সা: বললেন, মেয়েটিকে দেখে নাও। আনসারীদের চোখে আবার সমস্যা থাকে।’ (মুসলিম শরিফ)
পাত্র-পাত্রী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে নানা অপসংস্কৃতি প্রচলিত আছে। অপসংস্কৃতির বিষাক্ত ছোবল অপ্রতিরোধ গতিতে আমাদের সমাজকে গ্রাস করে নিচ্ছে। অপসংস্কৃতির ব্যাপক বিস্তারের ফলে আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে অপসৃত হচ্ছে ধর্ম ও সমাজের শতাব্দীর পর শতাব্দী লালিত ইসলামের মূল চেতনা। এসব অপসংস্কৃতির একটি হলো, উকিল বাবাকে নিজের বাবার মতো মনে করা। আমাদের দেশের অনেক এলাকায় দেখা যায়, বিয়ের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা সৃষ্টিকারী উকিল বাবাকে নিজের বাবার মতো মনে করা হয়। তিনি নিজে গিয়ে পাত্রী দেখে আসেন এবং তার কাছ থেকে বিয়ের অনুমতি এনে বিয়ের মজলিসে কনের পক্ষ হয়ে ওকালতি করেন। পরে তিনি কনের আপন বাবার মর্যাদায় ভূষিত হয়ে তার মাহরামদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। বিভিন্ন উপলক্ষে তিনি কনের পক্ষ থেকে মোটা অঙ্কের হাদিয়া-তোহফা পেয়ে থাকেন। তার সাথে পর্দা রক্ষা করা হয় না।
উকিল বাবা সাধারণত কনের মাহরাম কোনো আত্মীয়স্বজন হন না। বরং তিনি গাইরে মাহরামই হয়ে থাকেন। তার সাথে পর্দা করা ইসলামের দৃষ্টিতে ফরজ। শুধু সামাজিক প্রচলনের ওপর ভিত্তি করে একজন গাইরে মাহরাম ব্যক্তিকে উকিল বাবা ঠিক করে তার সাথে মাহরাম আত্মীয়স্বজনের মতো দেখা সাক্ষাৎ করা ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ নয়। ইসলাম সব গাইরে মাহরামের সাথে পর্দা করার নির্দেশ দিয়েছে। পর্দা নারীর সৌন্দর্য। নারীর মান-সম্মান, ইজ্জত-আব্রু হেফাজত করার জন্যই পর্দা রক্ষা করে চলা অপরিহার্য কতর্ব্য। কুরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে ও তাদের লজ্জাস্থান হেফাজত করে। তারা ‘যা সাধারণত প্রকাশ থাকে’ তা ব্যতীত তাদের আভরণ প্রদর্শন না করে। তাদের বক্ষদেশ ও গ্রীবা যেন মাথার কাপড় দিয়ে আবৃত করে। তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, আপন নারীরা, তাদের মালিকানাধীন দাসী, পুরুষদের মধ্যে যৌনকামনা রহিত পুরুষ ও নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক ব্যতীত কারো নিকট তাদের আভরণ প্রকাশ না করে। (সূরা নূর : ২৪-৩০)
আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, কাউকে উকিল বাবা ঠিক করার কারণে তার সাথে পর্দার বিধান রহিত হয়ে যায় না। কাজেই উকিল বাবার সাথেও পরিপূর্ণ পর্দা করতে হবে।
অনেক সময় মেয়ের কাছ থেকে অনুমতি আনার সময় সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত থাকার জন্য উকিল বাবার সাথে বর কনে উভয় পক্ষের দু’জন সাক্ষী যান। এই সাক্ষী রাখাকে জরুরিও মনে করা হয়। এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। শরিয়তের দৃষ্টিতে গাইরে মাহরাম কেউ মেয়ের কাছে অনুমতি আনার জন্য তার সাথে সরাসরি সাক্ষাৎ করতে পারবে না। বিয়ের আগে পাত্রীকে গাইরে মাহরামদের মধ্যে শুধু পাত্রই কিছু শর্তসাপেক্ষে দেখতে পারবে। নিচে শর্তগুলো উল্লেখ করা হলো।
১. পাত্রী দেখার সময় পাত্রের পক্ষের কোনো পুরুষ যেমন বাপ-ভাই, বন্ধু-বান্ধব প্রমুখ কেউ থাকতে পারবে না। পাত্রী দেখা তাদের জন্য সম্পূর্ণ হারাম ও কবিরা গুনাহ।
২. পাত্র-পাত্রী একে অপরের সাথে কথা বলতে পারবে। একে অপরের সম্পর্কে জানতে পারবে, জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে। তবে একে অপরকে স্পর্শ করতে পারবে না। অনেক এলাকায় স্পর্শ করার যে প্রচলন আছে, তা শরিয়ত অনুমোদিত নয়।
৩. পাত্রীর শুধু কব্জি পযর্ন্ত হাত, টাখনু পর্যন্ত পা ও মুখমণ্ডল দেখতে পারবে। এ ছাড়া শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ আবরণ ছাড়া দেখতে পারবে না। অনেক এলাকায় মেয়ের মাথার কাপড় ফেলে চুল দেখানোর প্রচলন আছে। সেটিও নিতান্তই ভুল।
৪. পাত্রীর কোনো মাহরাম পুরুষের উপস্থিতি ছাড়া পাত্রী দেখা জায়েজ নয়। সুতরাং নির্জনে পাত্র-পাত্রী একত্রিত হতে পারবে না।
৫. পাত্র-পাত্রী উভয়েই অপরকে প্রতারিত করার জন্য অস্বাভাবিক কোনো সাজসজ্জা করতে পারবে না। এতে প্রতারণার গুনাহ হবে। তবে শরীরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য স্বাভাবিক সাজসজ্জা করতে পারবে।


-মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াই

Saturday, December 20, 2014

যৌ তু ক : এক অভিশপ্ত সামাজিক ব্যধি, বহু কবীরা গুনাহর সমষ্টি

মুসলিম-সমাজে যখন অজ্ঞতা ও বিজাতির সংশ্রব একত্র হয়েছে তখন ভিন্ন সমাজের রোগ-ব্যধি ও রীতি-রেওয়াজে আক্রান্ত হওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়। সকল অন্যায় ও প্রান্তিকতা এবং শোষণ ও নির্যাতনমূলক রীতি-নীতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র আদর্শ ইসলামকে পেয়েও যারা সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করে না এবং বিজাতির অন্ধ অনুকরণের মোহ কাটাতে পারে না, শুধু আদম-শুমারির মুসলমানিত্ব কি পারবে ঐ সকল মরণ-ব্যাধি থেকে তাদেরকে রক্ষা করতে?

বর্ণবাদী হিন্দু ও ভোগবাদী ইংরেজের সংশ্রব থেকে উদাসীন মুসলমানদের মাঝে একদিকে যেমন অবিশ্বাস ও পৌত্তলিকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে অন্যদিকে অনাচার ও অশ্লীলতা এবং বহু নিপীড়নমূলক প্রথারও বিস্তার ঘটেছে। তবে ফিকরী কুফর ও চিন্তাগত অবিশ্বাসের তালিকায় সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে সেক্যুলারিজম আর সামাজিক প্রথা ও প্রচলনের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক বস্ত্ত হল যৌতুক। এর একটি যদি হয় চিন্তা ও মস্তিষ্কের পচন তো অন্যটি সমাজ-দেহের ক্যান্সার। একটি দ্বীন ও ঈমানের ঘাতক তো অন্যটি পারিবারিক শান্তি ও সামাজিক শৃঙ্খলার মৃত্যুদূত। এই দুই বস্ত্তর প্রথমটি হচ্ছে ইংরেজের উত্তরাধিকার আর দ্বিতীয়টি হিন্দু-সমাজের আশীর্বাদ।

দ্বিতীয় ব্যধিটি সম্পর্কেই বর্তমান নিবন্ধে কিছু কথা বলার ইচ্ছা করছি।
মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটি কথা। তা এই যে, جهاز আরবীতে একটি শব্দ আছে, جهاز যার উর্দু তরজমা করা হয় জাহীয। কেউ কেউ অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই এই শব্দের তরজমা করেন যৌতুক। যা সঠিক নয়।
জাহায বা জাহীয হচ্ছে, কন্যাকে দেওয়া পিতার উপহার। স্বামী বা শ্বশুরালয়ের কেউ এর মালিক নয়, এর মালিক কন্যা নিজে। পিতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কন্যাকে তা দিয়ে থাকে। এতে স্বামী ও শ্বশুরালয়ের দাবি ও চাপাচাপি তো দূরের কথা, কন্যার পক্ষ থেকেও কোনো দাবি থাকে না। এটা নামধামের জন্য দেওয়া হয় না। যৎসামান্য উপহার পিতা নিজের সামর্থ্য অনুসারে কন্যাকে দিয়ে থাকেন।
এই উপহারও বিয়ের সময় দেওয়া সুন্নত, মুস্তাহাব নয়; নিছক মোবাহ, যদি না কোনো সামাজিক চাপ কিংবা প্রথাগত বাধ্য-বাধকতা থাকে। অন্যথায় তা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম হয়ে যায়। হাদীস শরীফে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছেন-
ألا ولا يحل لامرئ من مال أخيه شيء إلا بطيب نفس منه
সাবধান! কারো জন্য তার ভাইয়ের কিছুমাত্র সম্পদও বৈধ নয়, যদি তার স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি না থাকে।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৫৪৮৮; সুনানে দারাকুতনী, হাদীস : ২৮৮৩; শুআবুল ঈমান বায়হাকী, হাদীস : ৫৪৯২
অর্থাৎ কেউ কিছু দিলেই তা ভোগ করা হালাল হয় না, যে পর্যন্ত না খুশি মনে দেয়। পুত্র-কন্যাও এ বিধানের বাইরে নয়। সুতরাং পিতা যদি বাধ্য হয়ে নিজের কন্যাকেও কোনো কিছু দেয় তবে তা গ্রহণ করা তার জন্যও বৈধ নয়। তাহলে স্বামী বা শ্বশুরালয় থেকে যদি কন্যার উপহার দাবি করা হয় কিংবা কোনো তালিকা দেওয়া হয় তাহলে তা কীভাবে বৈধ হবে? এ তো মোবাহ জাহিয নয়. সরাসরি যৌতুক।
কেউ কেউ রোখসতির সময় কন্যাকে কিছু উপহার, কিছু ঘরকন্নার সামগ্রি দেওয়াকে মাসনূন মনে করেন। এ প্রসঙ্গে সীরাতের একটি ঘটনা উল্লেখ করা হয় যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ কন্যা ফাতিমা রা.কে রোখসতির সময় কিছু জিনিস দিয়েছিলেন। মুসনাদে আহমদ (হাদীস : ৬৪৩) ও সহীহ ইবনে হিববানে (হাদীস : ৬৯৪৭) এ তিনটি বস্ত্তর কথা আছে। একটি ঝুলদার চাদর, একটি পানির মশক ও একটি বালিশ, যাতে ইযখির ঘাসের ছোবড়া ভরা ছিল। মুসনাদে আহমদের এক রেওয়ায়েতে (হাদীস : ৮৩৮) দুটি ঘড়া ও দুটি যাঁতার কথাও আছে।

কিন্তু উসূলে ফিকহের বিধান মতে শুধু এইটুকু ঘটনার দ্বারা কোনো আমল মাসনূন প্রমাণিত হয় না, শুধু মোবাহ বা বৈধ প্রমাণিত হয়। ঐ কাজ মাসনূন হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাতে উৎসাহিত করতেন এবং তাঁর অন্য কন্যাদের বিয়েতেও এ ধরনের উপহার দিতেন। তেমনি উম্মুল মুমিনীনদেরকেও তাদের পিত্রালয় থেকে উপহার দেওয়া হত। কিন্তু কোনো রেওয়ায়েতে এমন কোনো কিছুই পাওয়া যায় না। শুধু উম্মে হাবীবা রা. সম্পর্কে পাওয়া যায়, তাঁর জন্য হাবাশার বাদশা নাজাশী নিজের পক্ষ থেকে কিছু উপহার পাঠিয়েছিলেন। (সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ৩৩৫০; তবাকাতে ইবনে সাদ ৮/২৯৩)
ফাতেমা রা.-এর ঘটনার আরেকটি দিকও রয়েছে, যা বিবেচনা করা দরকার। তা এই যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন হযরত আলী রা.-এরও অভিভাবক। সুতরাং সম্ভাবনা আছে যে, ঐ জিনিসগুলো তিনি পাঠিয়েছিলেন আলী রা.-এর পক্ষ থেকে। কারণ বিয়ের সময় তাঁর ঘরে ঐ ধরনের কোনো আসবাবপত্র ছিল না। মুসনাদে আহমদ (হাদীস : ৬০৩) সহ বিভিন্ন কিতাবে নির্ভরযোগ্য সনদে এই তথ্য রয়েছে। মাওলানা মুহাম্মাদ মনযূর নুমানী রাহ. মাআরিফুল হাদীস (৩/৪৬০-৪৬১) এই ব্যাখ্যাই করেছেন।
কোনো কোনো রেওয়ায়েত থেকে বোঝা যায়, এই জিনিসগুলো দেওয়া হয়েছিল তাঁর মোহরের টাকা থেকে, কিন্তু ঐসব রেওয়ায়েত সহীহ নয়।
মোটকথা, রোখসতির সময় মেয়েকে কিছু উপহার দেওয়া বা ঘরকন্নার প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রদান করাকে কোনো সাহাবী ও তাবেয়ী মাসনূন বা মুস্তাহাব বলেছেন, এমন তথ্য আমার জানা নেই। ফিকহ-ফতোয়ার নির্ভরযোগ্য কিতাবের মোহর-অধ্যায়ের মাসায়েল থেকে এর বৈধতাটুকুই প্রমাণিত হয়।
মোটকথা, কন্যার বিয়ে বা রোখসতির সময় পিতা নিজ সাধ্য অনুসারে তাকে যে গহনাগাটি বা সামানপত্র শুধু আল্লাহর রেযামন্দির জন্য উপহার দেয় যাকে আরবীতে বলে জাহায, এবং উর্দূতে যার তরজমা জাহীয শব্দ দ্বারা করা হয় একে মোবাহ বা মুস্তাহাব যাই বলুন না কেন প্রচলিত যৌতুকের সাথে এর বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। এটা উর্দু ভাষার সীমাবদ্ধতা যে, তাতে যৌতুকের জন্যও জাহীয শব্দ ব্যবহার করা হয়। আর মূল আরবীতে তো যৌতুকের সমার্থক কোনো শব্দই নেই। কারণ সম্ভবত এই যে, ইসলামী যুগে তো দূরের কথা, জাহেলী যুগেও আরব-সমাজে আর যা কিছুই ছিল, যৌতুকের অভিশাপ ছিল না। সম্প্রতি আরবরা একটি বিদেশি শব্দের অপভ্রংশ ‘দাওতা’ যৌতুকের জন্য ব্যবহার করে থাকে।
যৌতুক শব্দের মূল প্রয়োগে কতটুকু ব্যাপকতা আছে তা আমার জানা নেই। তবে এখন তা একটি পরিভাষা। বিয়ের সময় বা বিয়ের আগে-পরে যে কোনো সময় কনে বা কনেপক্ষের নিকট থেকে বর বা বরপক্ষের লোকেরা যে সম্পদ বা সেবা গ্রহণ করে কিংবা সামাজিক প্রথার কারণে তাদেরকে দেওয়া হয়, তদ্রূপ কনে বা কনেপক্ষের লোকেরা মোহর ও ভরণ-পোষণের অধিক যা কিছু উসূল করে বা সামাজিক প্রথার কারণে তাদেরকে দেওয়া হয় এই সবই যৌতুক। এটিই বর্তমান নিবন্ধের বিষয়বস্তু।

একটি হারাম, অনেক হারামের সমষ্টি
যৌতুকের লেনদেন এত জঘণ্য অপরাধ যে, তা শুধু হারাম বা কবীরা গুনাহ নয়, এমন অনেকগুলো হারাম ও কবীরা গুনাহর সমষ্টি, যার কোনো একটিই যৌতুকের জঘণ্যতা ও অবৈধতার জন্য যথেষ্ট ছিল।
১. মুশরিক-সমাজের রেওয়াজ
যৌতুকের সবচেয়ে নগণ্য দিক হল, তা একটি হিন্দুয়ানি রসম বা পৌত্তলিক সমাজের প্রথা। আর কোনো মুসলিম কোনো অবস্থাতেই কাফের ও মুশরিকদের রীতি-নীতি অনুসরণ করতে পারে না।
২. জুলুম ও নির্যাতন
যৌতুক শুধু জুলুম নয়, অনেক বড় জুলুম। আর তা শুধু ব্যক্তির উপর নয়, গোটা পরিবার ও বংশের উপর জুলুম। যৌতুকের কারণে কনে ও তার অভিভাবকদের যে মানসিক পীড়ন ও যন্ত্রণার শিকার হতে হয় তা তো ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। অথচ কাউকে সামান্যতম কষ্ট দেওয়া ও জুলুম করাও হারাম ও কবীরা গুনাহ।
জালিমের উপর আল্লাহর লা’নত ও অভিশাপ এবং জালিমের ঠিকানা জাহান্নাম। মজলুমের ফরিয়াদ সরাসরি আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায় এবং যেকোনো মুহূর্তে আল্লাহ জালিমের উপর আযাব ও গযব নাযিল করতে পারেন।
৩. পরস্ব হরণ
কুরআন মজীদে একাধিক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
لا تأكلوا اموالكم بينكم بالباطل
তোমরা বাতিল উপায়ে একে অন্যের সম্পদ গ্রাস করো না।-সূরা বাকারা : ১৮৮; সূরা নিসা : ২৯
বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন-
إن دماءكم وأموالكم وأعراضكم عليكم حرام كحرمة يومكم هذا في شهركم هذا في بلدكم هذا.
নিঃসন্দেহে তোমাদের জান, মাল, ইজ্জত-আব্রু তোমাদের পরস্পরের জন্য এমনভাবে সংরক্ষিত, যেমন হজ্বের দিবসটি হজ্বের মাস ও (হজ্বের শহর) মক্কায় সংরক্ষিত।
সুতরাং কারো জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুতে হস্তক্ষেপ করা হজ্বের সম্মানিত মাসে, হজ্বের সম্মানিত দিবসে হারাম শরীফের উপর হামলার মতো অপরাধ। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৭৩৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৬৭৯)
নিঃসন্দেহে যৌতুক নেওয়া ‘আকল বিলবাতিল’ বা পরস্ব হরণের অন্তর্ভুক্ত। বিয়ে একটি পবিত্র বন্ধন। এটি ব্যবসা বা অর্থোপার্জনের উপায় নয়। তেমনি বর-কনেও ব্যবসার পণ্য নয়, যাদেরকে বিক্রি করে পয়সা কামানো হবে। যারা বিয়ের মতো পবিত্র কাজকে ‘সোর্স অফ ইনকাম’ বানায় তারা আল্লাহর বিধানের অবজ্ঞাকারী। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা যে ‘আকল বিল বাতিল’ কে হারাম করেছেন তার অর্থই হল, এমন কোনো পন্থায় সম্পদ উপার্জন, যাকে আল্লাহ উপার্জনের মাধ্যম বানাননি। শরীয়তের দৃষ্টিতে এটি হজ্বের মহিমান্বিত মাসের মহিমান্বিত দিবসে খানায়ে কাবার উপর হামলা করার মতো অপরাধ।
৪. ডাকাতি ও লুটতরাজ!
কে না জানে, অন্যের সম্পদ লুট করা কবীরা গুনাহ! বড় কোনো সম্পদ নয়, যদি জোর করে কেউ কারো একটি ছড়িও নিয়ে যায় সেটাও গছব ও লুণ্ঠন, যা সম্পূর্ণ হারাম। লুণ্ঠিত বস্ত্ত অনতিবিলম্বে ফিরিয়ে দেওয়া ফরয। হাদীস শরীফে ইয়াযীদ ইবনুস সায়েব রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
لا يأخذن أحدكم متاع صاحبه لعبا جادا وإذا أخذ أحدكم عصا أخيه فليرددها عليه
অর্থাৎ কেউ যেন তার ভাইয়ের জিনিস উঠিয়ে না নেয়; না ইচ্ছা করে, না ঠাট্টাচ্ছলে। একটি ছড়িও যদি কেউ তুলে নেয় তা যেন অবশ্যই ফিরিয়ে দেওয়া হয়। (মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৭৯৪০; ১৭৯৪১; ১৭৯৪২; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৫০০৩; জামে তিরমিযী, হাদীস : ২১৬০)
যৌতুক নেওয়া কারো সামান্য জিনিস তুলে নেওয়ার মতো বিষয় নয়; বরং তা সরাসরি লুণ্ঠন ও ডাকাতি। পার্থক্য শুধু এই যে, এখানে ছুরি-চাকুর বদলে বাক্যবান ও চাপের অস্ত্র প্রয়োগ করা হয়, যা মজলুমের মন-মানসে অনেক বড় ও গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। তো ডাকাতি ও লুটতরাজের যে গুনাহ যৌতুক নেওয়ার গুনাহও তার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।
৫. রিশওয়াত ও ঘুষ
আত্মসাৎ ও অবৈধ উপার্জনের যতগুলো পন্থা আছে তন্মধ্যে নিকৃষ্টতম ও জঘণ্যতম একটি পন্থা হল রিশওয়াত। এর বাংলা তরজমা করা হয় ‘ঘুষ’ বা ‘উৎকোচ’।
অনেকে মনে করেন, অফিস-আদালতে নিজের বা অন্যের কোনো বৈধ পাওনা উসূল করার জন্য বা সঠিক রায় পাওয়ার জন্য কর্মচারী-কর্মকর্তাদের চাপ, অশোভন আচরণের শিকার হয়ে যে অর্থ দেওয়া হয় কিংবা অবৈধ সুবিধা হাসিলের জন্য যা খরচ করা হয় তা হচ্ছে ঘুষ। অবশ্যই তা ঘুষ। তবে ঘুষ ও রিশওয়াত শুধু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। শরীয়তের দৃষ্টিতে রিশওয়াতের অর্থ আরো ব্যাপক। কারো কোনো হক বা পাওনা, যা কোনো বিনিময় ছাড়াই তার পাওয়া উচিত, তা যদি বিনিময় ছাড়া না দেওয়া হয় তাহলে ঐ বিনিময়টাই হল ঘুষ বা রিশওয়াত, যা হতে পারে অর্থ, সেবা বা অন্য কোনো সম্পদ। এটা দেওয়া হারাম, নেওয়া হারাম এবং এই লেনদেনে মধ্যস্থতা করাও হারাম। এটা এত বড় অপরাধ যে, এর সাথে যুক্ত সবার উপর আল্লাহর লা’নত ও অভিশাপ। (আননিহায়া ফী গরীবিল হাদীস ওয়াল আছার, ইবনুল আছীর (৬০৬ হি.) ২/২২৬; আলফাইক ফী গরীবিল হাদীস, যমখশরী (৫৩৮ হি.)
হাদীস শরীফে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
لعنة الله على الراشي والمرتشي
অর্থাৎ ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহীতা উভয়ের উপর আল্লাহর অভিশাপ। মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৬৭৭৮, ৬৯৮৪; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৫০৭৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৩১৩
অন্য হাদীসে আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
لعن الله الراشي والمرتشي والرائش الذي يمشي بينهما
ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহীতা ও ঘুষের লেনদেনে মধ্যস্থতাকারী সকলের উপর আল্লাহ অভিশাপ করেছেন।-আলমুস্তাদরাক আলাস সহীহাইন, হাকীম আবু আবদিল্লাহ ৪/১০৩
বিয়ের পয়গাম দিতে পারা নারী-পুরুষের বৈধ অধিকার। পয়গাম কবুল হলে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারাও নারী-পুরুষের বৈধ অধিকার। বিয়ের পর স্বামী তার স্ত্রীকে পাওয়া এবং স্ত্রী তার স্বামীকে পাওয়া তাদের প্রত্যেকের ফরয হক ও অপরিহার্য অধিকার। এরপর যতদিন বিবাহ-বন্ধন অটুট থাকে, একে অন্যের নিকট থেকে শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করাও স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য অধিকার। তো এই অধিকারগুলোর কোনো একটি পাওয়ার জন্য বা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য কোনোরূপ অর্থব্যয়ের বাধ্যবাধকতা সম্পূর্ণ অবান্তর। সুতরাং এক্ষেত্রে কোনো অর্থ-সম্পদ দাবি করা হলে কিংবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ চাপের মাধ্যমে কোনো কিছু গ্রহণ করা হলে তা হবে সরাসরি ঘুষ ও রিশওয়াত, যার লেনদেন সম্পূর্ণ হারাম এবং লেনদেনকারী ও মধ্যস্থতাকারী সবাই আল্লাহর লা’নত ও অভিশাপের উপযুক্ত।
৬. লালসা হিংস্রতা ও চারিত্রিক হীনতা
এই সব পাশবিক প্রবণতা থেকে নিজেকে মুক্ত করা প্রত্যেক নর-নারীর উপর ফরয। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে এইসব ঘৃণ্য প্রবণতা প্রকাশিত হওয়া চরম দুর্ভাগ্যজনক। যে সমাজের লোকেরা এই সব দোষ ও দুর্বলতার সংশোধন করে না; বরং কর্ম ও আচরণে পশুত্বের পরিচয় দিতে থাকে তাকে তো মনুষ্যসমাজ বলা যায় না। একজন ইনসান, উপরন্তু সে যদি হয় মুমিন, তাহলে অন্যের ধন-সম্পদ ও ইজ্জত-আব্রুর উপর কীভাবে হস্তক্ষেপ করে? কারো দুর্বলতা ও অসহায়ত্বের সুযোগ সে কীভাবে নেয়? এ তো কমিনা ও কমবখত লোকের কাজ। যার মাঝে বিন্দুমাত্র শরাফতও আছে তারও তো এই অপকর্মের হীনতা উপলব্ধি করা কঠিন নয়।
যৌতুক, সন্ত্রাস, নারী নির্যাতন এবং যত ধরনের দুর্নীতি এই সমাজে প্রচলিত তা সবই ঐ পাশবিক চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। এখন প্রত্যেকের কর্তব্য, নিজেকে ও নিজের অধীনস্ত সকলকে পশুত্বের হীনতা থেকে মনুষ্যত্বের মর্যাদায় উন্নিত করার চেষ্টা করা। এটা এখন সময় ও সমাজের অপরিহার্য-দাবি। আর এর একমাত্র উপায় হচ্ছে, আখিরাতের স্মরণ ও আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতিকে শক্তিশালী করা। এজন্য দ্বীনী শিক্ষার বিস্তার, আখলাক-চরিত্রের সংশোধন এবং নেককার বুযুর্গানে দ্বীনের জীবন ও আদর্শ চর্চার কোনো বিকল্প নেই।
৭. এক অপরাধ অসংখ্য অপরাধ
শরীয়তের একটি সাধারণ নীতি এবং একটি স্বতঃসিদ্ধ কথা এই যে, কোনো কাজের দ্বারা যদি হারামের দরজা খোলে তাহলে সেটাও হারাম হয়ে যায়। তাহলে যে কাজ নিজেও হারাম এবং আরো অনেক হারামের জনক তা কত জঘণ্য ও ভয়াবহ হতে পারে? তো যৌতুক এমনই এক অপরাধ, যা আরো বহু অপরাধের জন্ম দিয়ে থাকে।
যৌতুকের দাবি পূরণের জন্য অনেক অভিভাবক সুদ-ঘুষের কারবার ও বিভিন্ন হারাম উপার্জনে লিপ্ত হয়। এমনকি আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটে।
আর স্ত্রীর উপর নির্যাতন-নিপীড়ন এমনকি হত্যা ও আত্মহত্যাও সাধারণ বিষয়।
তেমনি কনেপক্ষ শক্তিশালী হলে দুই পরিবারে বিবাদ-বিসংবাদ, মামলা-মোকদ্দমা এমনকি খুন-জখম পর্যন্ত হতে থাকে। দৈনিক পত্রিকার পাঠক এসব ঘটনায় রীতিমতো অভ্যস্ত!
যৌতুকের সবচেয়ে ন্যূনতম ক্ষতিটি হল এর কারণে দাম্পত্য সম্পর্কের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়। পরিবারে অশান্তির আগুন জ্বলতে থাকে। ঝগড়া-বিবাদ গালিগালাজ এমনকি মারধর পর্যন্ত হয়। যার প্রত্যেকটিই এক একটি কবীরা গুনাহ এবং পরিবার ও সমাজকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে টেনে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সন্তানমাত্রই আল্লাহর রহমত, তবে কন্যা আল্লাহর বিশেষ রহমত কিন্তু যৌতুকের কারণে অনেক পিতামাতা কন্যার প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন, যা চরম মূর্খতা ও জাহিলিয়াত।
আরো বেদনার বিষয় এই যে, ছেলের মা বোনেরাও নববধুর কাছে যৌতুক দাবি করতে পিছপা হয় না। নারী হয়েও তারা নারীর যন্ত্রণা বোঝে না, তার প্রতি সহমর্মী হয় না। অনেক ক্ষেত্রে তো জা-ননদ-শাশুড়িই হয়ে ওঠে নব বধুর সবচেয়ে বড় দুশমন।
তো যারা যৌতুক দাবি করে বা গ্রহণ করে তাদের উচিত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই বাণী স্মরণ রাখা-
لا يدخل الجنة لحم نبت من سحت النار أولى به
ঐ দেহ বেহেশতে যাবে না, যা হারাম (গিযা) থেকে উৎপন্ন হয়েছে। দোযখের আগুনই তার অধিক উপযোগী।-সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ১৭২৩, ৪৫১৪; মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস : ২০৭১৯
তদ্রূপ যারা এই কু-রসমের প্রতিরোধ করে না; বরং নিজেদেরকে অক্ষম মনে করে কিংবা যৌতুক দিয়ে জামাতার মনোতুষ্টি কামনা করে তাদের মনে রাখা উচিত, কারো পাপ-দাবি পূরণ করাও পাপ। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা তাদের দ্বিতীয়বার স্মরণ করা উচিত-ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহীতা উভয়ের উপর আল্লাহর অভিশাপ।
এই অভিশপ্ত ব্যধি থেকে আল্লাহ আমাদের সমাজকে পবিত্র করুন, সকল কুফরী ও শিরকী কর্মকান্ড থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন এবং একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এই সকল অপকর্মের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলার তাওফীক দান করুন।

Wednesday, December 17, 2014

ক) আমাদের বিবাহ কি সঠিক হয়েছিল? খ) আমাদের মধ্যে তালাক হয়েছিল কি?

প্রশ্ন:

এক মেযের সাথে আমার গোপনে পরিচয় হয়। স্থায়ী সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে আমার কয়েকজন বন্ধুবান্ধবসহ একটি রেস্টুরেন্টে একত্রিত হই। আমার এক বন্ধু কাজী অফিসের পিয়ন হিসেবে একজনকে নিয়ে আসে। সে কাজী অফিস থেকে বিবাহ রেজিস্ট্রি করার কাগজপত্র সঙ্গে নিয়ে আসে। এছাড়াও সরকারি দলিল-স্ট্যাম্পে একটি বিবাহ হলফনামা নিয়ে আসে। সেখানে আমরা উভয়ে স্বেচ্ছায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার নিমিত্তে স্বাক্ষর করি এবং নিকাহনামা রেজিস্টারেও উভয়ে স্বাক্ষর করি। সেখানে চারজন পুরুষও উপস্থিত ছিল। এছাড়া বিবাহ পড়ানোর উপযুক্ত কোনো ব্যক্তি বা কাজী অফিসের কেউ উপস্থিত ছিল না। উক্ত কাগজপত্রে স্বাক্ষরের মাধ্যমে ১,০০,০০১ টাকা দেনমোহরের শর্তে আমরা বিবাহ সম্পন্ন করি। কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা কেউই ইজাব-কবুল বলিনি। পিয়ন আমাদের বললেন, আপনারা দুজন স্বামী স্ত্রী। এরপর আমরা যার যার মতো চলে আসি।
বিয়ের ২-৩ মাসের পর থেকে আমাদের মধ্যে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বাকবিতন্ডা হয়। ৩-৪ মাস পর এক পুরুষ শিক্ষক নিয়ে পর্দার ব্যাপারে আমার সাথে ওর ঝগড়া হয়। আমি রাগ করে একপর্যায়ে বলেছিলাম, তুমি যদি কালকে, পরশু এবং এর পরের দিন তার কাছে পড় তাহলে তুমি যথাক্রমে এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক। পরে জানতে পারি, সে তিন দিনই পড়েছিল। এখন প্রশ্ন হল, ক) আমাদের বিবাহ কি সঠিক হয়েছিল? খ) আমাদের মধ্যে তালাক হয়েছিল কি? গ) এখন আমি পারিবারিকভাবে ওকে ঘরে তুলতে বা বিয়ে করতে চাই। এজন্য আমার কী করা উচিত বা আদৌ কি তা সম্ভব?

উত্তর:
প্রশ্নের বর্ণনা অনুসারে আপনাদের মাঝে ঐ বিবাহই সংঘটিত হয়নি। কারণ প্রশ্নে উল্লেখ করেছেন যে, আপনাদের মধ্যে বিবাহের ইজাব-কবুল হয়নি। মৌখিক ইজাব-কবুল না হলে শুধু লেখালেখির দ্বারা বিবাহ সম্পন্ন হয় না। সুতরাং প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে আপনাদের হলফনামা ও নিকাহনামাটি অবাস্তব। আর আপনাদের মাঝে যেহেতু বিবাহই হয়নি তাই পরবর্তীতে তালাকও পতিত হয়নি। আর আপনাদের পরস্পর এতদিন যাবত দেখা-সাক্ষাত ও মেলামেশা এবং ফোনে যোগাযোগ রাখা সম্পূর্ণ অবৈধ ও হারাম হয়েছে। আল্লাহ তাআলার দরবারে উভয়কে তওবা-ইস্তিগফার করতে হবে। সামনে একত্রে সুষ্ঠুভাবে ঘরসংসার করতে চাইলে যথানিয়মে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে।

-ফাতহুল কাদীর ৩/১০২; রদ্দুল মুহতার ৩/, ২২৭, ১২; আলবাহরুর রায়েক ৩/৮৩

Saturday, December 13, 2014

সদ্য বিবাহিত ছেলে-মেয়ের জন্য অমূল্য উপদেশ

শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু


বিয়ের সময় পুত্রের উদ্দেশ্যে পিতার উপদেশ, তুমি এক নব্য জগতে এবং এক নতুন জীবনে পা রাখতে যাচ্ছ। তাতে অনেক কল্যাণ সৌন্দর্য রয়েছে, সুন্দরভাবে পরিচালিত নিয়ন্ত্রিত করতে পারলে তুমি তা দেখতে পাবে। আবার তাতে অনেক অপ্রিয় তিক্ত দিক রয়েছে যা তোমার জীবন দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। তাই তোমাকে যথাযথ পরিচালনা উত্তরোত্তর উন্নতি করতে শিখতে হবে। আর অবশ্যই তোমাকে জীবন সঙ্গিনী সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। তুমি দশটি বিষয়ে লক্ষ্য না রাখলে নিজ ঘরে শান্তি পাবে না। নিজের স্ত্রীর জন্য তুমি বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখবে। অতএব কথাগুলো মনে রেখ এবং এসব অর্জনে সচেষ্ট থেকো :

প্রথম দ্বিতীয় বিষয় হলো : স্ত্রীরা প্রেম ভালোবাসাপূর্ণ আচরণ পছন্দ করে এবং তারা ভালোবাসার সুস্পষ্ট উচ্চারণ শুনতে চায়। অতএব তোমার স্ত্রীর সাথে ব্যাপারে কার্পণ্য দেখাবে না।

তৃতীয় বিষয় হলো : স্ত্রীরা কঠোর অনড় স্বভাবের পুরুষদের অপছন্দ করে, আর দুর্বল কোমল চিত্তধারী পুরুষদের ব্যবহার করে। অতএব প্রতিটি গুণকে স্বস্থানে রাখবে। কারণ, এটি ভালোবাসা ডেকে আনে এবং প্রশান্তি ত্বরান্বিত করে।

চতুর্থ বিষয় হলো : মেয়েরা স্বামীর কাছে তাই প্রত্যাশা করে স্বামীরা স্ত্রীর কাছে যা প্রত্যাশা করে। যেমন : ভদ্রোচিত কথা, সুন্দর চেহারা, পরিচ্ছন্ন বসন সুগন্ধি। অতএব তোমার প্রতিটি অবস্থায় এসবের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। স্ত্রীকে নিজের মতো করে কাছে পেতে তার কাছে এমন  অবস্থায় ঘেঁষবে না যখন তোমার শরীর ঘামে জবজবে।তোমার কাপড় ময়লা। 

পঞ্চম বিষয় হলো : ঘর হলো নারীদের রাজত্ব। ঘরের মধ্যে তারা নিজেকে নিজের আসনে সমাসীন ভাবে। নিজেকে সেখানকার নেতা মনে করে। অতএব তার সাজানো এই প্রশান্তির রাজ্যটিকে তুমি তছনছ করতে যাবে না। আসন থেকে তাকে নামাবার চেষ্টাও করবে না। তুমি যদি তা- করো, তবে তাকে যেন তার রাজত্ব থেকে উচ্ছেদ করলে। 

ষষ্ঠ বিষয় হলো : নারী যেমন চায় তার স্বামীকে পেতে; তেমনি তার পরিবারকেও সে হারাতে চায় না। অতএব তুমি কিন্তু তার পরিবারের সঙ্গে  নিজেকে এক পাল্লায় মাপতে যাবে না। 

সপ্তম বিষয় হলো : নিশ্চয় নারীকে সবচেয়ে বাঁকা হাড় দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। এটি তার দোষ নয়। বরং তার সৌন্দর্যের রহস্য। তার আকর্ষণের চাবিকাঠি। যেমন ভ্রুর সৌন্দর্য তার বক্রতায়। অতএব সে কোনো ভুল করলে তার ওপর এমন হামলা চালিও না যাতে কোনো সহমর্মিতা বা সদয়তা নেই। 

অষ্টম বিষয় হলো : নারীদের সৃষ্টিই করা হয়েছে স্বামীর অকৃতজ্ঞতা এবং উপকার অস্বীকারের উপাদান দিয়ে। তুমি যদি যুগযুগ ধরে তাদের কারো প্রতি সহৃদয়তা সদাচার দেখাও তারপর শুধু একটিবার তার সঙ্গে মন্দ ব্যবহার কর তবে সে বলবে, তোমার কাছে আমি জীবনে ভালো কিছুই পেলাম না। অতএব তাদের বৈশিষ্ট্য যেন তোমায় তাকে অপছন্দ বা ঘৃণায় প্ররোচিত না করে। কারণ, তোমার কাছে তার বৈশিষ্ট্যটি খারাপ লাগলেও অনেক গুণ দেখবে তার ভালো লাগার মতো।

নবম বিষয় হলো : নানাবিধ শারীরিক দুর্বলতা মানসিক ক্লান্তির মধ্য দিয়ে নারী জীবন বয়ে চলে। দিকে লক্ষ্য রেখেই আল্লাহ তাআলা তাদের  জন্য কিছু ফরয পর্যন্ত ক্ষমা করে দিয়েছেন যা সময় কর্তব্য ছিল। যেমন রজস্রাব সন্তান প্রসবকালে তার জন্য পুরোপুরিভাবে সালাত মাফ করে দিয়েছেন। সময়দুটোয় সিয়াম পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। যতক্ষণ না তার শরীরিক সুস্থতা ফিরে আসে এবং তার মেজাজ স্বাভাবিক হয়ে যায়। অতএব সময়গুলোয় তুমি আল্লাহর ইবাদতমুখী হয়ে যাবে। কারণ, তার জন্য আল্লাহ যেমন ফরযকে হালকা করে দিয়েছেন তেমনি তার থেকে তোমার চাহিদা নির্দেশও হালকা করে দিয়েছেন।

দশম বিষয় হলো : মনে রাখবে স্ত্রী কিন্তু তোমার কাছে একজন বন্দিনীর মতো। অতএব তার বন্দিত্বের প্রতি সদয় থাকবে এবং তার দুর্বলতাগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে। তাহলে সে হবে তোমার জন্য সর্বোত্তম সম্পদ। সে তোমার সর্বোত্কৃষ্ট সঙ্গী হবে। আল্লাহ তোমার কল্যাণ করুন। 



বিয়ের রাতে বিদায়ী কন্যার প্রতি মমতাময়ী জননীর একগুচ্ছ উপদেশ: হে আমার মেয়ে, তুমি তোমার বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছো। যেখানে তুমি জন্মেছিলে।যে বাসস্থানে তুমি প্রতিপালিত হয়েছো। যাচ্ছো এমন পরিবেশে যার সঙ্গে তুমি মোটেও পরিচিত নও। মিলিত হবে এমন সঙ্গীদের সঙ্গে যাদের তুমি চেনো না। অতএব তুমি তার দাসী হয়ে যাও।সে তোমার দাস হয়ে যাবে।আর তার জন্য তুমি ১০টি বৈশিষ্ট্য ধারণ করো, তবে সে তোমার জন্য সঞ্চিত ধন হয়ে যাবে।

প্রথম দ্বিতীয়টি হলো : স্বামীর সঙ্গে থাকবে অল্পে তুষ্টির সঙ্গে এবং জীবনযাপন করবে আনুগত্য মান্যতার ভেতর দিয়ে।

তৃতীয় চতুর্থটি হলো : স্বামীর নজরে পড়ার জায়গাগুলো দেখাশোনা করবে এবং তার নাকে লাগার স্থানগুলো খুঁজে ফিরবে। তার দুই চোখ যেন তোমার কুৎসিত কিছুর প্রতি পতিত না হয়। আর সুবাস ছাড়া তোমার কাছে যেন কোনো গন্ধ না পায়। 

পঞ্চম ষষ্ঠটি হলো : স্বামীকে খাওয়াবার সুযোগ তালাশ করবে এবং তাঁর নিদ্রার সময় নিরব থাকবে। কারণ, ক্ষুধার তাপ মানুষকে তাতিয়ে দেয়। আর ঘুম থেকে কেঁপে ওঠা তাকে ক্ষেপিয়ে দেয়।

সপ্তম অষ্টম হলো : স্বামীর বাসা সম্পদের যত্ন নেবে এবং তাঁর তাঁর পরিবারের প্রতি লক্ষ্য রাখবে।

নবম দশম হলো : তার কোনো নির্দেশ অমান্য করবে না এবং তার কোনো দোষ খুঁজে বের করবে না। কারণ, তুমি তার নির্দেশের অবাধ্য হলে অর্থ তার মনটাকে চটিয়ে দিলে। যদি তার কোনো দোষ প্রকাশ করলে তো তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করায় অনিরাপদ হয়ে গেলে। এরপর আরও মনে রাখবে, তাঁর বিষণ্নতার সময় আনন্দ প্রকাশ করবে না। আবার তাঁর আনন্দের সময় বিষণ্নতা প্রকাশ করবে না। কারণ,প্রথমটি তার কাছে অবহেলা মনে হবে এবং দ্বিতীয়টি তাকে বিরক্ত করবে। তাকে সবচে মর্যাদা তুমি তখনই দেবে যখন তাঁকে সবচে বেশি সম্মান করবে। অবশেষে প্রার্থনা, আল্লাহ তোমার সার্বিক কল্যাণ করুন। তোমাদের দাম্পত্য জীবনকে সুখময় করুন।
আমীন